তুষার যুগ

 

বিখ্যাত আনিমেশন ছবি Ice Age-এর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে তোমাদের? যার পরপর ৪টি সিরিজ বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। সেই বিশাল হাতি ম্যানি, কিংবা দাঁতালো বাঘ দিয়াগোকে দেখে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে যে এমন প্রাণী আদৌ ছিল কিনা!

হ্যাঁ, এমন সব ভয়ানক কিংবা বিস্ময়কর প্রাণী পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতো একসময়। কিন্তু সেটা এখনকার কথা নয়, আমি বলছি এখন থেকে কয়েক মিলিয়ন বছর আগের কথা। যখনকার পৃথিবী আজকের পৃথিবীর মতো এমন সবুজ ছিল না, বরং তখন পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ বরফে ঢাকা ছিল, এবং এমন অবস্থা শুধু একবার না, বারবার হয়েছে পৃথিবীর বুকে। হ্যাঁ, আমি বলছি “তুষার যুগ” কিংবা “Ice Age”-এর কথা।

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বারবার এর তাপমাত্রা উঠানামা করেছে, তাপমাত্রা বেশী কমে গেলে তুষারে ঢেকে  গিয়েছে পুরো পৃথিবী, আর এমন অবস্থাকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন “তুষার যুগ” বা “Ice Age”।

                                             

কিন্তু তুষার যুগ ঘটার জন্য তাপমাত্রার যে পরিবর্তন দরকার, তা অনেক লম্বা সময় ধরেই হয়নি। এই তুষার যুগগুলো সবসময় পুরো পৃথিবীকে তুষারে ঢেকে দেয়নি, কখনও পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অংশ বরফে ঢেকে গিয়েছে, আবার কখনও পুরো পৃথিবী বরফে ঢেকে গিয়ে একটা বিশাল তুষারের বল-এ পরিণত হয়েছে। এই তুষার বল অবস্থাটিকে “Snowball Earth” বলা হয়ে থাকে।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উত্তপ্তকারী গ্যাসের পরিমাণ কমে গেলেই তাপমাত্রা কমতে থাকে। আর এ গ্যাসগুলোর মধ্যে মিথেন আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণই বেশী। যখন এই গ্যাসগুলোর পরিমাণ কমে যায়, তখনই পৃথিবীর তাপমাত্রা কমতে থাকে, এবং “তুষারীকরণ” শুরু হয়, তাপমাত্রা কমে গিয়ে ভূপৃষ্ঠ তুষারে ঢেকে যাওয়াকেই তুষারীকরণ বলা হয়। এই  গ্যাসগুলোর পরিমাণ কমে গেলে যেমন চারদিক বরফে ঢেকে যায়, তেমনই এদের পরিমাণ বেড়ে গেলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করে এবং বন্যা দেখা দেয়। এর প্রমাণ Ice Age সিরিজের দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যায়।

উত্তপ্তকারী গ্যাসের পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনা তুষার যুগকে আমন্ত্রণ জানায়, তার মধ্যে একটি হচ্ছে পৃথিবীর গতি। পৃথিবীর কক্ষপথ বেশ স্থির হলেও মাঝে মাঝে এর গতিতে কিছু পরিবর্তন আসে, পৃথিবীর গতিপথ কখনো বৃত্তাকার, আবার কখনো ডিম্বাকার হওয়ার ফলে সূর্য থেকে আগত তাপ শোষণের পরিমাণ কমে যায় এবং তুষার যুগ শুরু হয়। আবার গতিপথ পরিবর্তনের ফলে বিপরীতও ঘটতে পারে, তাপ শোষণের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে তুষার গলতে পারে এবং মহাপ্লাবন দেখা দিতে পারে।

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বেশ কিছু তুষার যুগের সম্মুখীন হয়েছে। তার মধ্যে সর্বশেষ “Snowball Earth” অবস্থা ঘটেছিল ৬৩৫ মিলিয়ন বছর আগে। এরপর আর এই তুষার বল অবস্থা ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু অংশবিশেষে তুষার যুগ তার রাজত্ব বিরাজ করেছে, যার প্রভাব থেকে উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু এখনও মুক্ত হতে পারেনি। গত ২.৬ মিলিয়ন বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্র কমবেশী ৪০টির মতো তুষার যুগ পার করেছে। সবচেয়ে কাছের তুষার যুগটি শেষ হয়েছে ১২০০০ বছর আগে উত্তর আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকায় ঘটে যাওয়া গত ৪টি তুষার যুগের প্রত্যেকটি ১০০০০০ বছর স্থায়ী ছিল। আবার প্রত্যেকটির মাঝখানে ১০০০০ বছরের বিরতি দেখা যায়, তার মানে গড়ে প্রত্যেকটি তুষার যুগ ৯০০০০ বছর ধরে বিরাজমান ছিল।

 

তুষার যুগ ঘটার জন্য তাপমাত্রার যে পরিবর্তন দরকার, তা খুব তাড়াতাড়ি আর ঘটার কোন সুযোগ নেই। কারণ পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়তে থাকার ফলে এর তাপমাত্রা দিন দিনই বাড়ছে, এবং এর ফলে যেটুকু বরফ অবশিষ্ট আছে, তাও গলতে শুরু করেছে। সুতরাং Ice Age 2-এর মতো মহাপ্লাবন ঘটার হয়তো খুব বেশী দেরি নেই যদি না এখন থেকেই মানুষ সাবধান হয়।

 

 

 

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন