সে হয়তো অনেক বছর আগের কথা , সালটা হয়তো ২০০১ না হয় ২০০০। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এক দূর সম্পর্কের দাদুর বাসায় বেড়াতে গেছিলাম আমি। দুপুরের খাবার শেষ করে আমি আর এলমা এক দৌড় দিয়ে মাঠে নামলাম খেলার জন্য। কি সুন্দর ছিল মাঠটা। মাঠে দোলনা দেখে আমার আনন্দ কে দেখে ! এক দৌড়ে বসলাম দোলনার উপর আর তখনি হটাৎ এলমা বলল যে আপু দেখে যা কি অদ্ভুত জিনিস! দোলনা থেকে উঠার ইচ্ছা আমার ছিল না কিন্তু তবুও বোনের কাছে আসলাম অদ্ভুত জিনিস দেখতে। কিন্তু কি অদ্ভুত জিনিসরে এইটা ! আমি দেখে বললাম "ছোট ছোট চারটা পাতা কি হল এইটা দেখার মতো"। খুবই রাগ করলাম আমি বোনের উপর। ওকে বললাম যে, “কি এমন অদ্ভুত দেখলি তুই একটু বলতো”।
ও কিছু বললো না, কিন্তু হাত দিয়ে ঠিকই দেখালো। ছোট এই পাতাগুলিতে হাত দেওয়ার সাথে সাথে সঙ্কুচিত হয়ে গেলো। কি অদ্ভুত ! তাৎক্ষণিক মাথা থেকে দোলনার ভূত দূর হয়ে গেলো আর সারা মাঠের সকল লজ্জাবতী গাছগুলো আমাদের কল্যাণে লজ্জায় নির্জীব হয়ে গেলো।
ছোটকালের সেই স্মৃতি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু তা আবার মনে পড়লো ক্লাস সেভেনের বিজ্ঞান ক্লাসে। উদ্ভিদ প্রজাতির অধ্যায়টা পড়তে গিয়ে আবারও নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম লজ্জাবতী গাছকে। তখন খুব জানতে ইচ্ছা করলো এই অদ্ভুত গাছের অদ্ভুত রহস্য।
আমরা সবাই এই উদ্ভিদকে লজ্জাবতী নামে জানলেও এর আরও নাম আছে, নামগুলো হচ্ছে- সমঙ্গা, লজ্জালু, অঞ্জলিকারিকা। ইংরেজীতে Sensitive Plant,Sleepy Plant বা Touch-me-not বলা হয়ে থাকে লজ্জাবতী গাছকে। লজ্জাবতী গাছের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Mimosa Pudica। বছরের সবসময় লজ্জাবতী গাছ রোপণ করা যায় । যেহেতু বছরের যে কোনোসময় এই গাছ লাগানো যায় তা স্বভাবতই একে বছরের যে কোন সময় সংগ্রহও করা যায়। বারো মাসই এর ফুল ও ফল হয়। তবে সাধারনত জুলাই থেকে ডিসেম্বর মধ্যে ফুল ও ফল বেশী হয়। লজ্জাবতী গাছ খুব ছোট গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ তা সত্ত্বেও এর ফল হয় এবং ফলের মধ্যে ধূসর বর্ণের ছোট ছোট কাঁটা থাকে।
লজ্জাবতী গাছ কমবেশি আমরা সবাই দেখেছি। গুল্ম জাতীয় এই উদ্ভিদটি লতা গড়িয়ে গড়িয়ে বেড়ে উঠে। এর গায়ে অসম্ভব বাঁকা কাঁটা থাকে, নীচের দিকে থাকে বিধায় আমাদের চোখে পড়ে না। এর পাতার বোঁটা এক থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা ও পাতাগুলি ঠিক বিপরীতভাবে সাজানো। পুষ্পদন্ড ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। ফুল তুলার মতো নরম ও ফিকে লাল বর্ণের বা কিছুটা বেগুনী বর্ণের হয়।
গাছ সম্পর্কে তো জানা হলো। এখন এর নির্জীব হওয়ার রহস্য জানা বাকি আছে। লজ্জাবতী গাছের লজ্জার প্রধান কারণ হচ্ছে এই উদ্ভিদটি খুব স্পর্শকাতর । লজ্জাবতীর পাতা স্পর্শ করলে এর পাতলা আবরণের কোষ থেকে জলকণা কাণ্ডে চলে যায় । এর ফলে গাছের কাণ্ডে এক ধরনের উদ্দিপনা তৈরী হয় যার ফলে গাছের দেহ থেকে পটাশিয়াম আয়ন বের হয়ে যায়। এই পটাশিয়াম আয়ন ত্যাগের কারণে পাতার টারগার প্রেসার (Turgor Pressure) কমে যায়। টারগার প্রেসার কমার ফলে পাতা থেকে পানি অপসারিত হয় । তখন এর কোষগুলো সংকুচিত হয় এবং দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে । এজন্য পাতাগুলো সঙ্কুচিত হয় ।
লজ্জাবতীর কাজ শুধু সঙ্কুচিত হয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয় না এর অনেক ঔষধী গুনাগুন রয়েছে যা হয়তো আমাদের অনেকেই অজানা। রক্তপিত্তের সমস্যা, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্যে,দাঁতের মাড়ি ক্ষয় ইত্যাদি রোগের ঔষধী গাছ হিসেবে এই উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়।