বলা হয়ে থাকে যে, প্রস্তর যুগে শিল্প বিপ্লবই আধুনিক সমাজের সামাজিকীকরণের স্তম্ভ । কারণ ধাতু শিল্পের হাতে খড়ির সূচনা এই প্রস্তর যুগে থেকেই শুরু হয়। ধাতু বা লোহার প্রয়োজনীয়তা জানতে বেশী কিছু দেখতে হয় না আমাদের, রুমের জানালায় ধাতুর কাঠামো দেখলেই হয়। কি মনে হয় ধাতু ছাড়া আধুনিক সভ্যতা কি সম্ভব ছিল? উত্তরটা হচ্ছে না। আজ বাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তা কিংবা সেটা হয় বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার বা ফুটওভার ব্রিজ সবই আজ বানানো সম্ভব শুধু মাত্র এই ধাতু শিল্পের কারণে। এই বিশাল ইমারতের সবটুকুই তো স্টিলের কাঠামো আর এর উপর ইট পাথরের মিশ্রণ।
ধাতুর তৈরি সবচাইতে সুন্দর নিদর্শন হচ্ছে ইংল্যান্ডের আয়রন বিজ( Iron Bridge)। তাই ব্রিজ বা বাড়ি রাস্তা যাই তৈরি করি না কেন এই ধাতুগুলোকে জোড়া লাগিয়ে এর কাঠামো প্রস্তুত করা হয়। তাহলে কিভাবে এই ধাতু জোড়া লাগানো সম্ভব ?
ধাতুদেরকে সাধারন আঠা বা গাম দিয়ে জোড়া লাগানো যায় না, তবে তাদেরকে উত্তপ্ত করে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় একত্রিত করা যায় যার নাম ওয়েল্ডিং। ওয়েল্ডিং এর মূলনীতিটা সহজ – দুটো ধাতুকে উচ্চতাপে উত্তপ্ত করে যাতে তারা গলে গিয়ে জোড়া লেগে একীভূত (Fusion)হয়। এই পদ্ধতিতে দুটো ভিন্ন ধরণের ধাতুও জোড়া লেগে এক হতে পারে। ওয়েল্ডিংয়ের ফলে একীভূত ধাতুর টুকরোটি আরো মজবুত হয়।
সাধারণত ওয়েল্ডিংয়ে তাপ দেওয়ার সময় আরো কিছু পদার্থ যোগ করা হয়, যেমন – ফিলার ও ফ্লাক্স। ফিলার হলো অতিরিক্ত একটি ধাতুর টুকরো, যা তাপ দেওয়ার সময় দুই ধাতুর সংযোগস্থলে দেওয়া হয়। ফলে কোন গ্যাপ থাকলে তা পূরণ হয়ে যায়। আর ফ্লাক্স হলো একধরনের অধাতব রাসায়নিক পদার্থ যা গলিত ধাতুগুলোকে বাতাসের সাথে বিক্রিয়া করে অক্সাইড ও নাইট্রাইড গঠন করতে বাধা দেয়। কারণ এদের অক্সাইড ও নাইট্রাইড ধাতুর মিশ্রণকে দুর্বল করে দেয়।
ফ্লাক্স ব্যবহারের বদলে এমন স্থানেও ওয়েল্ডিং করা যায় যেখান থেকে বাতাস সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অথবা বাতাসকে নিষ্ক্রিয় গ্যাস (যেমন – আর্গন) দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।
ওয়েল্ডিংয়ে তাপটাই মুখ্য হলেও তাপ প্রদানের জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ওয়েল্ডিংয়ে ব্যবহার হয় এমন একটি যন্ত্র হল অক্সি-অ্যাসিটিলিন গ্যাস টর্চ। এই যন্ত্রের মাধ্যমে অ্যাসিটিলিনকে অক্সিজেনের মাধ্যমে পুড়িয়ে তীব্র উত্তাপ সৃষ্টি করা হয়। এই যন্ত্রটি বহনযোগ্য হলেও বেশ দামী, কারন অ্যাসিটিলিন গ্যাস সিলিন্ডারেও ব্যবহৃত হয়। কলকারখানায় এরচেয়েও বেশি শক্তিশালী ও বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতির নাম আর্ক ওয়েল্ডিং।
এখানে গ্যাস টর্চের বদলে এক ধরনের ধাতব দণ্ড ব্যবহৃত হয় যার নাম ইলেক্ট্রোড। এই ইলেক্ট্রোডগুলো উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক উৎসের সাথে সংযুক্ত থাকে। এই ইলেক্ট্রোডগুলো যখন দুই ধাতুর সংযোগস্থলে লাগানো হয় তখন সেখানে বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা আর্কের সৃষ্টি হয় যার ফলে প্রচণ্ড উত্তাপে ধাতু দুটি গলে গিয়ে একীভূত হয়। তবে এই পদ্ধতিও সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। বৈদ্যুতিক স্পার্কের ফলে যেমন দৃশ্যমান চোখ ধাঁধানো আলো উৎপন্ন হয় তেমনি অদৃশ্য অতিবেগুনি রশ্মিও তৈরি হয়। এগুলো চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি মানুষকে অন্ধও করে দিতে পারে। তাই আমরা সবসময় ওয়েল্ডিংয়ের শ্রমিকদেরকে দেখি চোখে প্রোটেকটিভ গ্লাস পড়ে কাজ করতে। এছাড়াও ওয়েল্ডিংয়ের আরো কিছু পদ্ধতি আছে, যেমন – আল্ট্রাসোনিক, লেজার ও ইলেকট্রন বীম।
শত বছর আগে যখন এইসব সুবিধা ছিল না, তখন মানুষ প্রেসার ওয়েল্ডিং নামে এক পদ্ধতিতে দুই ধাতু জোড়া লাগাতো। সেই যুগের কামাররা হাপরের (Forge)মাধ্যমে দুটি ধাতুকে উত্তপ্ত করে তারপর তা গরম থাকতে থাকতেই হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে একীভূত করত। এটি ওয়েল্ডিংয়ের প্রাচীনতম পদ্ধতিগুলোর একটি।