দুই ধারে দৃষ্টিনন্দন স্থলভুমি, আর মাঝ দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমান জল। এই ধরনের পানিপথকেই বলা হয় প্রণালী।প্রণালী হল দুটি নদী বা সমুদ্রের সংযোগকারী সংকীর্ণ জলপ্রবাহ বা ধারা। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের আগে যখন জলপথ ছিল দুটি দেশের মাঝে যোগাযোগের সেরা মাধ্যম, তখন থেকেই মানুষ বিভিন্ন প্রণালীর গুরুত্ব বুঝতে পারে। এই প্রণালীগুলো শুধু প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং মানবজাতির উন্নয়নের ইতিহাসেও তাদের রয়েছে প্রত্যক্ষ অবদান। পর্ব ১ এ আমরা জেনেছি জিব্রাল্টার প্রণালী, মালাক্কা প্রণালী, পক প্রণালী ও সিঙ্গাপুর প্রণালী নিয়ে। আজ থাকছে প্রণালী নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব।
বেরিং প্রণালী:
প্রশান্ত মহাসাগর ও উত্তর মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত বেরিং প্রণালী (Bering Strait) রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রণালীর নাম রাখা হয় ডেনমার্কের পরিব্রাজক ভিতাস বেরিংয়ের নামানুসারে। হিম শীতল জায়গাটিতে মানুষের বসবাস তেমন না থাকলেও বিজ্ঞানীদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বিজ্ঞানীদের ধারণা যে, মানুষ এশিয়া থেকে বেরিং প্রণালী দ্বারা উত্তর আমেরিকায় প্রথম পৌছায় যখন এই প্রণালীর পানির স্তর কমে যায়।
প্রণালীটির সবচেয়ে সরু জায়গাটি ৮২ কিলোমিটার চওড়া। এটি উত্তর দিকে চুকচি সাগর ও দক্ষিন দিকে বেরিং সাগরের সাথে যুক্ত। কোল্ড ওয়্যারের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বর্ডার হিসাবে দেখা হতো বেরিং প্রণালীকে। একে আইস কার্টেইন বর্ডার নামেও অবিহিত করা হয়। সেই সময় এটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে পর্যটকের জন্য এর বিমান ও নৌপথ খুলে দেওয়া হলেও আমেরিকা ও রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখানে ভ্রমনের ভিসা ও অনুমতি পেতে ঝামেলা পোহাতে হয় পর্যটকের।
বসফরাস প্রণালী:
ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে অবস্থিত এই প্রণালীকে “কনস্ট্যান্টিনোপোলের প্রণালী” বা “ইস্তাম্বুলের প্রণালী” নামেও অবিহিত করা হয়। বসফরাস, মারমার সাগর ও দারদানেলেস প্রণালী মিলে একসাথে তুর্কি প্রণালী গঠন করে। বসফোরাসের গড় গভীরতা ৬৫ মিটার। এটি প্রাচীন ইস্তাম্বুলের নিরাপত্তার সাথে গভীরভাবে জড়িত। মূল প্রণালীর অন্যতম মোহনা “গোল্ডেন হর্ন” প্রাচীন ইস্তাম্বুলের পরিখা হিসাবে কাজ করতো।
বিশ্বের নৌ চলাচলে ব্যবহৃত সবচেয়ে সরু জলপথ বসফরাস প্রণালী। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে নৌ যোগাযোগের অন্যতম পথ এই প্রণালী। ইতিহাসের বিভিন্ন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এই পথে, তাদের মাঝে অন্যতম হলো – Russo-Turkish War (1877–78) এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে Battle of Gallipoli। প্রণালীর ৩১ কিলোমিটার অংশে জাহাজ বন্দরের অনুমতি রয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর এই প্রণালীর তীর ঘেঁষে প্রায় ৬২০টি ওয়াটারফ্রন্ট হাউজ রয়েছে যা মূলত অটোমান পিরিয়ডে তৈরি হয়েছিল।
হরমুজ প্রণালী:
পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রণালী হিসাবে পরিচিত এই হরমুজ প্রণালী। গুরুত্বপূর্ণ হবেই না বা কেন, গোটা পৃথিবীর ২০% পেট্রোলিয়াম যে এই প্রণালী দিয়েই পার হয়! ওমান উপসাগর ও পারস্য উপসাগরের মাঝে অবস্থিত এই প্রণালীটিই পারস্য উপসাগর থেকে খোলা সমুদ্রে যাবার একমাত্র পথ। তাই, এটি পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চোক পয়েন্ট।
U.S. Energy Information Administration এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি তেলবাহী ট্যাংকার হরমুজ প্রণালী দিয়ে পার হতো এবং তারা প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল অশোধিত তেল বহন করতো। এই অঞ্চল দিয়ে তেল পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে। তবে তেল পরিবহনের আগেও এই প্রণালী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ১ দিনের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ ঘোষণা করে ইরানের বিরুদ্ধে এবং এই প্রণালীতে আক্রমণ করে। ইতিহাসে এই আক্রমণ অপারেশন প্রেয়িং ম্যান্টিস নামেও পরিচিত। ২০০৭ সালের শেষে ও ২০০৮ সালের প্রথম দিকে হরমুজ প্রণালীতে বেশ কয়েকবার ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী মুখোমুখি হবার উপক্রম হয়।
তাইওয়ান প্রণালী:
তাইওয়ান প্রণালী বা ফরমোসা প্রণালী ব্ল্যাক ডিচ নামেও পরিচিত। ১৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই প্রণালী এশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ানকে পৃথক করে রেখেছে। এটি দক্ষিন চীন সাগরের একটি অংশ। চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের বেশ খানিক অংশ এই প্রণালীর পশ্চিমে অবস্থিত।
দ্বীপের সাধারন লোকজনের কাছে এই প্রণালী হলো মাছ ধরার অন্যতম স্থান। মিন আর জিউলং নদী এই প্রণালীতে এসে মিশে। ১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের সময়ে বেশ কিছু মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এই প্রণালীতে।