লোক বাদ্যযন্ত্র : হরেক রকম বাঁশি (পর্ব ১)

বাংলাদেশে বাঁশি সবচেয়ে জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। সব সম্প্রদায়ের ছোট-বড় সব শ্রেণির মানুষ বাঁশি বাজিয়ে আনন্দোপভোগ করে। বাঁশি এক ধরনের শুষির অর্থাৎ ফুৎকার (ফুঁ) দিয়ে বাজানো যায় এমন বাদ্যযন্ত্র। বাঁশ (বংশ) দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে এর নাম বাঁশি। বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয়।

মুখ্যত সংগীতানুষ্ঠানে বাঁশি বাজানো হয়। আবার বিভিন্ন উপলক্ষ বা অনুষ্ঠান ছাড়াও বাঁশি বাজানো যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে লোকে আনন্দের টানে বাঁশি বাজায়, আর তার সুমিষ্ট সুরে বিভোর হয়ে অনেকেই সংগীত-পিপাসা নিবৃত্ত করে। বাঁশি স্বয়ংসিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র; সুতরাং নাচ, গান বা অন্য বাদ্য ছাড়াই স্বয়ং নানা রাগে সুর তুলতে পারে।

বিশেষত রাখাল বালকের বাঁশির খুব ভক্ত। তারা ভেনু চরায় আর বাঁশি বাজায়। রাখাল বেশে বালক কৃষ্ণ এভাবে বাঁশি বাজাতেন। নানা প্রকার লোকসংগীতে অন্য বাদ্যের সাথে বাঁশি বাজানোর রীতি আছে। ভাওয়াইয়া গানে দোতারার সঙ্গে এবং সারিগানে সারিন্দার সঙ্গে বাঁশি ব্যবহার করা হয়। অনুরূপভাবে যাত্রাগানে ঢোলকের সঙ্গে এবং বিষহরী গানে খোলের সঙ্গে বাঁশি ব্যবহার করা হয়।

বাঁশি তৈরি
বাঁশির উপকরণ অতি সাধারণ- তরলা বাঁশের সরু একটি ‘পোড়’ হলেই চলে। তরলা বাঁশ নরম ও হালকা হয়ে থাকে। এর দুই গিঁট এর মধ্যবর্তী অংশকে পোড় বলা হয়। উপরের দিকের গিঁট রেখে পোড় কেটে তাতে ছিদ্র করে বিভিন্ন প্রকার বাঁশি তৈরি করা হয়। কেউ কেউ শখের বশে ষ্টিলের, তামার, পিতলের, রূপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরি করিয়ে থাকেন। কোনও কোনও বাঁশির উভয় মুখ খোলা থাকে। আকৃতি ও প্রকৃতিভেদে বাঁশির গায়ে পাঁচ থেকে আটটি ছিদ্র থাকতে পারে। শাস্ত্রীয় পরিভাষায় ছিদ্রগুলোকে ‘তারাবন্ধ্র’ বলে।

Flute making
ছবি : সংগৃহীত

লম্বায় ছোট, মাঝারি ও বড় বাঁশির প্রচলন রয়েছে। বাঁশির দৈর্ঘ্য কম হলে স্বর সূক্ষ্ণ ও তীক্ষ্ণ হয়। বেশি হলে স্বর গম্ভীর ও স্থির হয়। সাধারণত বাঁশির সুর মধুর ও হৃদয়গ্রাহী। তবে বাঁশির গঠনের দৈর্ঘ্য, ব্যাসার্ধ, আয়তন, ছিদ্র-সংখ্যা, ছিদ্র-স্থানের দুরত্ব, এক মুখ খোলা বা দুই মুখ খোলা ইত্যাদি শর্তের উপর এ সুরের মাধুর্যের তারতম্য ঘটে। আকার-প্রকারভেদে বাঁশির একাধিক নাম রয়েছে। ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ গ্রন্থে ১৫ প্রকার বাঁশির উল্লেখ আছে।

বাংলার গ্রামাঞ্চলে আড়বাঁশি, সরলবাঁশি, কদবাঁশি, টিপরাবাঁশি, লয়াবাঁশি ইত্যাদির নাম পাওয়া যায়। এছাড়াও গাছের পাতা দিয়ে তৈরি পাতবাঁশি, আমের আঁটি দিয়ে ‘ভেঁপু’ নামের লোকজ বাঁশি তৈরি করা হয়।

আড়বাঁশি

aarbashi
ছবি : সংগৃহীত

আড়বাঁশি বা মুরলী অধিক লোকপ্রিয় বাদ্য। প্রায় এক হাত লম্বা এই বাঁশিতে মোট সাতটি গোল ছিদ্র থাকে। এগুলোর মধ্যে একটি উপরে গিঁটের কাছে, অন্যগুলো নিচের দিকে একই রেখা বরাবর থাকে। বাঁশিটি আড়াআড়িভাবে মুখের কাছে ধরে ফুঁ দেওয়া হয়; আর ছয়টি ছিদ্রপথে দুই হাতের ছয় আঙ্গুলের সঞ্চালন দ্বারা স্বর নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর স্বর অত্যন্ত মধুর ও উচ্চমার্গীয় হয়। অধিকাংশ লোকসংগীতে বাঁমি বানারো রেওয়াজ আছে।

কদবাঁশি
কদবাঁশির আকৃতি একটু ভিন্নধর্মী, এর ফুঁ দেওয়ার ছিদ্রটি মাথায় থাকে, যা হুইসেলে মতো মুখে পুরে বাজানো হয়। এজন্য এটি তেরচা করে কাটা হয়। এতেও সুর তোলার জন্য একই রেখায় ছয়টি ছিদ্র থাকে। বাঁশিটি সোজাসুজি ধরে বাজাতে হয়। মুখের আকৃতি কলমের মতো বলে এর নাম ‘কলমবাঁশি’, মুখে পুরে বাজানো হয় বলে উত্তরবঙ্গে ‘মুখাবাঁশি’, মুখটি খিলযুক্ত থাকে বলে ফরিদপুরে ‘খিলাবাঁশি’ বলে।

সরলবাঁশি
সরলবাঁশিও মুখে পুরে সোজাসুজি ধরে বাজানো হয়। এর মুখের ছিদ্রের কাছে আর একটি বায়ূরন্ধ্র বা ছিদ্র থাকে যেখান দিয়ে বায়ু নির্গত হয়ে সুরের উপর প্রভাব ফেলে।

টিপরাবাঁশি
টিপরাবাঁশি আকৃতি একটা নল বা চোঙার মতো। বাঁশির উপরের দিকে অবস্থিত ছিদ্রে ঠোঁট লাগিয়ে বাজাতে হয়। এর উভয় প্রান্ত খোলা বলে শুধু ফুঁ দিলেই হয় না, বিশেষ কায়দায় তা বাজাতে হয়। বাঁশির গায়ে একই সারিতে সমান দূরত্বে সাতটি ছিদ্র থাকে। ত্রিপুরা জেলায় এর প্রচলন থাকায় এরূপ নামকরণ হয়েছে।

লয়াবাঁশি
দীর্ঘাকৃতির লয়াবাঁশি মূলত আদিবাসীদের বাঁশি। বাঁশিটি মুখের এক কোনে একটু বক্রভাবে ধরে ফুঁ দিতে হয়।

পাতবাঁশি

Patbashi
ছবি : সংগৃহীত

শুধু গাছের পাতা মুখে পুরে সামান্য বাঁকা করে হাতে ধরে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়। দক্ষ বাদক এর সাহায্যে গানের সুর পর্যন্ত তুলতে পারে। তালপাতার তৈরি আর এক ধরণের পাতবাঁশির প্রচলন রয়েছে। শিরা ছাড়া তালপাতা চিরে পরিমাণমতো নিয়ে পেঁচিয়ে ভাঁজ করে ছোট থেকে বড় অর্থাৎ মঙ্কুবৎ আকার দেওয়া হয়। পরে ঐ ছোট মুখে ফুঁ দিলে পোঁ…. পোঁ ধ্বনি সৃষ্টি করে। গ্রামের বালকেরা এরূপ বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ পায়। বঙ্কিম-রচনায় মেলা থেকে কিনে আনা ‘এক পয়সার তালপাতা বাঁশি’র উল্লেক আছে।

ভেঁপু
পাকা আমের আঁটির অঙ্কুর গজিয়েছে কিংবা চারা সামান্য বড় হয়েছে, এরূপ অবস্থায় তা মাটি থেকে তুলে বাইরের শক্ত খোলস ছড়িয়ে নিয়ে একপাশ তেরচাভাবে ঘষে কদবাঁশির মতো ‘মুখা’ তৈরি করতে হয়। এই তেরচা অংশ মুখে পুরে ফুঁ চিলে পুঁ.. পুঁ ধ্বনি সৃষ্টি হয়। এতে পল্লীর ছেলেমেয়েরা খুব আনন্দ উপভোগ করে। এ সুর খুবই স্থূল, বয়স্করা তা ব্যবহার করে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন