১৮১৫ সালের ১৮ জুন বেলজিয়ামের ওয়াটারলু নামক স্থানে ঐতিহাসিক ওয়াটারলু’র যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বেনাপার্ট এই যুদ্ধে সম্মিলিত ব্রিটিশ-প্রাশান সেনাবাহিনীর নিকট পরাজিত হন এবং পরবর্তীতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।
ভূমধ্যসাগরের কর্সিকা দ্বীপে জন্ম নেয়া নেপোলিয়ন বেনাপার্ট ১৭৮৫ সালে ফরাসি মিলিটারি একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন এবং সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৭৮৯ সালে ‘ফরাসি বিপ্লবের‘ সময় নেপোলিয়ন নিজেকে মেধাবী এবং অকুতোভয় সেনা হিসেবে প্রমাণ করতে থাকেন। ফলে ক্রমান্বয়ে নেপোলিয়নের পদমর্যাদা বাড়তে থাকে। ১৭৯৯ সালে ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং নেপোলিয়ন ফ্রান্সের প্রথম কৌন্সুলি হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮০৪ সালে নেপোলিয়ন বেনাপার্ট নিজেকে ফ্রান্সের প্রথম সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন।
ঊনিশ শতকের প্রথমভাগে নেপোলিয়ন বেনাপার্ট ফরাসি সম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটান। নেপোলিয়ন পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশ দখল করেন এবং ফরাসি সম্রাজ্যের অধিভুক্ত করেন। ফলে অন্যান্য দেশগুলো নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু নেপোলিয়নের তখন পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না। কারন পূর্ববর্তী রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে অত্যধিক শীত, খাদ্য সংকট এবং প্রতি আক্রমণের মুখে নেপোলিয়নের অর্ধেকের বেশি সৈন্য মারা পড়ে। ১৮১৪ সালে প্রাশা, অস্ট্রিয়া সহ অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনী প্যারিসকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। নেপোলিয়নকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করা হয় এবং তাঁর সৈন্যরা তাকে সেন্ট এলবা দ্বীপে নির্বাসিত করে।
নেপোলিয়নের অনুপস্থিতিতে ষোড়শ লুই ক্ষমতায় আসেন এবং পুনরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ফরাসি জনগন তা ভালভাবে নেয়নি। নির্বাসিত হওয়ার পরের বছর নেপোলিয়ন এলবা দ্বীপ থেকে পালিয়ে ১০০০ সৈন্য নিয়ে ফ্রান্সে প্রবেশ করে। ষোড়শ লুই ভয়ে পালিয়ে যান এবং নেপোলিয়ন আবার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ইউরোপের অন্য দেশ গুলো নেপোলিয়নের আগমন ভাল চোখে নেয়নি। তারা আবার সম্মিলিত ভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহন করতে থাকে। এর মধ্যে ছিল ডিউক অব ওয়েলিংটনের অধীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং গাবার্ড ভন বুচারের অধীন প্রাশান সেনাবাহিনী। নেপোলিয়ন ঠিক করেন প্যারিস আক্রমণ করার পূর্বেই তিনি যুক্ত শক্তিকে আক্রমণ করবেন।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং প্রাশান সেনাবাহিনী তখন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণের একটা গ্রামে অবস্থান করছে। নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনী নিয়ে বেলজিয়ামে যাত্রা করেন।
১৮১৫ সালের ১৮ জুন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে ওয়াটারলু’র প্রান্তরে যুদ্ধ করার দুই দিন আগে নেপোলিয়ন প্রাশান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে প্রাশান সেনাবাহিনী পরাস্ত হয়। তবে নেপোলিয়ন প্রাশান সেনাবাহিনীকে পুরোপুরিভাবে বিধ্বস্ত করতে ব্যর্থ হন। প্রায় তিরিশ হাজার প্রাশান সেনা পালিয়ে যায়।
দুইদিন পর, নেপোলিয়ন প্রায় ৭২ হাজার সৈন্য নিয়ে ডিউক অব ওয়েলিংটন আর্থার ওয়েসলির নেতৃত্বে ৬৮ হাজার সৈন্য বিশিষ্ট ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়। আগের দিন ভারি বর্ষণ হওয়ায় নেপোলিয়ন মাটি শুষ্ক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ইতোমধ্যে ৩০ হাজার দলছুট প্রাশান সৈন্য এসে ব্রিটিশদের সাথে যোগ দেয়। ওয়াটারলুতে তুমুলযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার ফরাসি সৈন্য এবং ২২ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য আহত এবং নিহত হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এই যুদ্ধে দুইটি সম্মিলিত শক্তি, যথা- ডিউক অব ওয়েলিংটনের অধীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং গাবার্ড ভন বুচারের অধীন প্রাশান সেনাবাহিনীর নিকট পরাজিত হন।
ফরাসিদের এ পরাজয়ের পেছনে যুদ্ধের কৌশলগত সমস্যা, অপর্যাপ্ত কমান্ডার নিযুক্ত করন, যুদ্ধে দেরীতে আক্রমণ এবং সর্বোপরি অতিরিক্ত প্রাশান সৈন্যের সংযুক্তি কে কারন হিসেবে দেখা হয়। ২২ জুন পরাজিত সম্রাট নেপোলিয়ন বেনাপার্ট ফ্রান্সে ফিরে আসে এবং সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হন। এর সাত দিন পর যুক্ত শক্তি প্যারিসে প্রবেশ করে।