Diorama: চোখের সামনে ধরা দেয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগে গেলে মনে হয় যেন সুন্দরবনে চলে এসেছি। কাঁচের দেয়ালের ভেতর তৈরি করা হয়েছে এক কৃত্রিম সুন্দরবন। জঙ্গলের আদলে তৈরি পরিবেশে বাঘ, হাতি, অজগর, নানা রকমের পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণী দিয়ে সাজানো হয়েছে কাঁচের বাক্সগুলো। সামনে দাঁড়ালে মনে হয় যেন সত্যি জীবন্ত। বাস্তবতার সাথে মিল রেখে এ ধরণের কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে যেকোনো স্থানের এ রকম ক্ষুদ্র মডেল দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য অনেক জাদুঘরেই পাওয়া যায়। শুধু মনোরঞ্জন নয়, যেকোনো বিশাল দালান তৈরির আগে এই ধরণের মডেল বানিয়ে দেখানো হয়। এই মডেলগুলোকে ডাইওরোমা (Diorama) বলে। ডাইওরোমা শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ “di” এবং “orama” থেকে। “di” মানে হল through বা মধ্য দিয়ে, আর “orama” মানে হল see বা দেখা। শুরুতে ডাইওরোমা বলতে কোনকিছুর ক্ষুদ্র মডেল বোঝালেও এখন আর এই মডেলগুলো ক্ষুদ্র নেই। ক্ষেত্রবিশেষে কখনও কখনও মডেলগুলো মূল বস্তুকেও আকারে ছাড়িয়ে যায়।

একটু অতীতে ঘুরে আসা যাক। ১৮২৩ সালে সর্বপ্রথম ডাইওরোমাটি তৈরি করেন Daguerre এবং Charles Marie Bouton, তাঁদের তৈরি ডাইওরোমাটি প্রদর্শন করা হয় লন্ডনে। এই ডাইওরোমাটি ছিল মূলত একটি তৈলচিত্র, যেটার পেছনে আলো জ্বালিয়ে পরিবেশ পাল্টে দেয়া যেত। যেমন, দিনের আলোতে দেখে মনে হত ছবিটি  চাঁদের আলোর পটভূমিতে আঁকা, আবার রাতের বেলা দেখলে মনে হত ছবিটি সূর্যের আলোর পটভূমিতে আঁকা। এই ডাইওরোমাটি ছিল দ্বিমাত্রিক, যার কারণে সবসময় এই ধরণের মডেল ব্যবহার করে সঠিক পরিবেশ তৈরি সম্ভব হয় না।

এখন আর দ্বিমাত্রিক ডাইওরোমা তৈরি হয় না বললেই চলে, ত্রিমাত্রিক ডাইওরোমাই সবখানে রাজত্ব  করে চলেছে। কিন্তু Daguerre এবং Charles-এর তৈরি সেই দ্বিমাত্রিক ডাইওরোমাটিই যে তখন সাড়া ফেলে দিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক উভয় ধরণের ডাইওরোমা তৈরিতে শিল্পীরা ব্যাপক উৎসাহ পান। ডাইওরোমা যে শুধু দালান নির্মাণের ব্যবসায়িক কাজে বা বন-জঙ্গল দেখাতে তৈরি হয়, তা কিন্তু নয়। ইতিহাসকে চোখের সামনে দেখার অন্যতম একটি মাধ্যম হল এসব ডাইওরোমা।

গ্রেট ব্রিটেনের Whitehall-এ The Banqueting House নামে একটি বিখ্যাত জাদুঘর ছিল যা ১৯৬৮ সালের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। এই জাদুঘরে অসংখ্য বিখ্যাত সব ডাইওরোমার সংগ্রহ ছিল। বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় সবগুলো ডাইওরোমা অন্যান্য ছোট জাদুঘরে দিয়ে দেওয়া হয়। এই ডাইওরোমাগুলোর বেশীরভাগই ছিল Otto Gottstein নামক এক জার্মান ধনী শিল্পীর। তাঁর তৈরি ঐতিহাসিক ডাইওরোমাগুলোর মধ্যে ছিল- The Landing of the Romans under Julius Caesar in 55 B.C., The Battle of Hastings, The Battle of Quebec, The Old Guard at Waterloo, The Queen Elizabeth reviewing her troops at Tilbury ইত্যাদি। এছাড়াও Frank Wong নামক এক বিখ্যাত ডাইওরোমা নির্মাতার তৈরি সাতটি ডাইওরোমা এখনও আমেরিকার Chinese Historical Society of America-তে প্রদর্শিত হয়। এগুলো হল- The Moon Festival, Shoeshine Stand, Chinese New Year, Chinese Laundry, Christmas Scene, Single Room এবং Herb Store।

আধুনিক সময়ের ত্রিমাত্রিক ডাইওরোমা দেখতে অদ্ভুত রকমের সুন্দর হলেও এগুলো তৈরি খুব একটা জটিল নয়। ডাইওরোমাগুলোর Surface বা তলভাগ সমান না করে একটু উঁচুনিচু রাখা হয়, যাতে করে উপর থেকে দেখার সময় একে সহজে কৃত্রিম না মনে হয়। এরপর Background বা পেছনের দিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ পেইন্টিং আঁকা হয়। এরপর ডাইওরোমাটি দিয়ে যে ঘটনা, পরিবেশ বা সময় দেখানো হবে, তার সাথে সম্পর্কিত জিনিস দিয়ে সাজানো হয়। যেমন, একটি জঙ্গলের ডাইওরোমা তৈরি হলে পেছনে জঙ্গলের ছবি থাকবে, surface-এর উপর কিছু কৃত্রিম  গাছপালা, ঝোপঝাড় থাকবে, এবং কৃত্রিম পশুপাখি থাকবে। কোন যুদ্ধের ডাইওরোমা তৈরি করা হলে ক্ষুদ্র মানুষের মডেলকে সৈন্য বানিয়ে এবং খেলনার গাড়ি, জাহাজ এবং অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার করা হয়। তবে যেকোনো খেলনার মডেল এখানে ব্যবহার হয় না, ঐ যুদ্ধে ব্যবহার করা যানবাহনের আদলে এসব মডেল তৈরি করা হয়।

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন