খেলার মাঠে হাজারো দর্শক থাকে খেলোয়াড়দের উৎসাহ প্রদানের জন্য। কিন্তু তাদের মধ্যে দু’একজনই নজর কাড়তে পারেন। গত কয়েক বছর ধরে যারা মাঠে গিয়ে কিংবা টেলিভিশনে খেলা দেখেন তারা অবশ্যই বাংলাদেশের খেলায় একজন দর্শককে দেখেই থাকেন। দেশের মাঠে কিংবা বিদেশে বাংলাদেশের খেলা চললেই তাকে দেখা যায়। বাঘের বেশে প্রতিটা খেলায় মাঠে হাজির হন তিনি। নাম তার শোয়েব আলী বুখারী।
পাকিস্তানের জলিল চাচা বা ভারতের সুধীর যেমন তাদের ক্রিকেটের আইকনিক সাপোর্টার, তেমনিভাবে বাংলাদেশের আইকনিক সাপোর্টার হলেন এই শোয়েব আলী। বাংলাদেশের প্রতিটা খেলার সময়, অনুশীলনের সময় বাঘের মতো সারা শরীর অলঙ্কৃত করে অবিরাম চিৎকার করে চলেন তিনি।
প্রচন্ড রোদ বা তাপ, পরবর্তী খাবার কীভাবে জুটবে কিংবা কোথায় ঘুমাবেন এসব চিন্তা তার মাঝে কখনও কাজ করে না। যতোই প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হোক না কেনো বাংলাদেশের খেলায় তার মাঠে থাকা চাই। প্রতিটি খেলার আগে সকালে তিনি শরীরে রঙ করেন আবার খেলা শেষ হলে সেগুলো ধুয়ে ফেলেন।
একবার তামিম ইকবাল তাকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তবে নিরাপত্তা কর্মীদের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।
শোয়েব আলী বুখারী – ‘আমি ছোটবেলায় যখন অন্যদের মতো আড্ডা না দিয়ে টেস্ট ম্যাচ দেখতাম তখন মানুষ আমাকে ক্ষ্যাপাতো। অভিভাবকরাও রাগ করতেন। বলতেন, আমার কোন ভবিষ্যৎ নেই। আমি নাকি জীবনে কিছুই করতে পারবো না। কিন্তু যখন খেলা থাকে না, তখন আমি বিভিন্ন বন্ধুর দোকানে গাড়ি ঠিক করে টাকা জমাই। কারণ আমার ইচ্ছা আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সমর্থন দিতে বিভিন্ন দেশে যেতে চাই। বাংলাদেশ যে একটা সুন্দর দেশ তা সবাইকে জানাতে চাই’।
বুখারির পিতা মসজিদের ইমাম। বাসায় মা ছাড়াও আছেন বড় বোন। একমাত্র ছেলের এই পাগলামি বাসায় যে মেনে নেয়া কঠিন তা স্বীকারও করেন তিনি। বলেন, ‘আগে মানতো না। তাই ঢাকা চলে এসে বাড্ডায় থাকি। তবে এখন তাদের অনেকটা সয়ে গেছে। তবে বলেছে, গায়ে রঙ মেখে বাসায় ঢোকা যাবে না। রঙ ধুয়ে যেতে হবে’।
তবে বাংলাদেশের এই ক্রিকেট পাগল দর্শক বিশ্বাস করেন বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর সেরা দল হবে। তিনি বলেন, ‘জয়-পরাজয়, সুখ-দুঃখ আছেই। জিতলে আমি সুখ পাই। আর হারলে দুঃখ। তবে জানি, বাংলাদেশ একদিন অনেক ভালো করবে।
দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত তথ্যমতে, শোয়েবের ক্রিকেট দেখার শুরুটাই খানিকটা পাগলামি থেকে। ফরিদপুরের ছেলে শোয়েব পেশায় একজন মোটর মেকানিক। নিজেই একগাল হেসে বলেন, ‘লেখাপড়া কিছু জানি না’। লেখাপড়া না জানলে কী হবে, মেকানিকের কাজ করতে করতে খেলার প্রেমে ঠিকই পড়ে গিয়েছিলেন। শোয়েব যতদূর মনে করতে পারেন, বাংলাদেশের খেলা নিয়ে তার নেশাটা পাগলামিতে পরিণত হয় ২০০৩ সালে বাংলাদেশের পাকিস্তান সফরের সময়।
এর আগেও খেলাটা নিয়ে তার উন্মাদনা ছিল। কিন্তু সেবার বিশেষত মুলতান টেস্টে দলের খেলা দেখে, বলা যায় পরাজয়টা দেখে তিনি প্রেমে পড়ে যান বাংলাদেশ দলের। তার মনে হচ্ছিল, মুলতানে যদি গ্যালারিতে বাংলাদেশের হয়ে কেউ চিৎকার করতে পারতো, তাহলে ১ উইকেটের ওই ট্রাজিক হারটা সহ্য করতে হত না।
শোয়েব প্রথম মাঠে গিয়ে খেলা দেখেন ২০০৪ সালে; নিউজিল্যান্ডের বাংলাদেশ সফরের সময়। আফতাব আহমেদ ৫ উইকেট নিলেন, কিন্তু ম্যাচ হেরে গেল বাংলাদেশ। সে সময়ও তার মনে হয়েছে, গ্যালারিতে বসে এমন কিছু করা দরকার, যাতে খারাপ সময়েও খেলোয়াড়রা উৎসাহ পান।
একটা উপায় আছে চিৎকার করা; সেটা সবাই করেন। শোয়েবই বলছিলেন পরের উপায়টা মাথায় আসার কথা, ‘আমার মনে হল, একটা কিছু করা দরকার, যাদের খেলোয়াড়রা দূর থেকে দেখে শক্তিটা পায়। ভাবলাম যে, শরীরে জাতীয় পতাকার রং করবো। আর মুখটা বাঘের মতো করে আঁকবো। তাহলে আমার চিৎকার শুনে খেলোয়াড়রা উৎসাহ পাবে’।
এই ভাবনা কাজে লাগাতে অবশ্য সময় লাগলো। ২০১১ সালের এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো এমন সাজে গ্যালারিতে হাজির হয়েছিলেন শোয়েব। সে অভিযানেই সফল। সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে, দুই বিশ্বকাপ জয়ী দলকে ছিটকে দিয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ!
অবশ্য কাজটা সহজ ছিল না শোয়েবের জন্য।
প্রথমে চারুকলায় গিয়ে এক শিল্পীকে খুঁজে বের করলেন। তিনি শোয়েবের চাহিদা মতো শরীরে রং করে দিলেন। প্রতিবার রং করতে ১৫০০ টাকা। শোয়েব হেসে বলেন, ‘পকেটে নাই টিকিট কেনার টাকা! এতো টাকা কি করে রোজ দেব। তাই রং কিনে আয়নার সামনে বসে নিজেই এরপর থেকে একে ফেলা শুরু করলাম’। সেই শুরু। এরপর থেকে বাংলাদেশের খেলা মানেই মাঠে শোয়েব আছেন, টাইগার আছে। বাংলাদেশের খেলা দেখতে জীবন হাতে নিয়ে, প্রায় সর্বস্ব বিক্রি করে শ্রীলঙ্কা গেছেন। সেখানে গ্যারেজে থেকেছেন, খেলোয়াড়দের দেয়া টাকায় খাওয়া চলেছে। জিম্বাবুয়ে গেছেন খেলোয়াড়দের দেয়া টাকায়। বাঘ সাজার আগেই ২০০৬ সালে ডিসকভারীর মতো করেই ভারতে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফির খেলা দেখবেন বলে।
শোয়েবের উত্সাহ, শোয়েবের পাগলামি নিয়ে বলতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। শরীরে একশ’ পাঁচ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে খেলা দেখেছেন, প্রবল শীতের দিনে খুলনায় খালি গায়ে খেলা দেখতে গিয়ে নিউমোনিয়া বাধাতে বসেছিলেন, সস্তা রং দিয়ে শরীর রাঙাতে গিয়ে চর্মরোগ বাধিয়ে বসেছিলেন। যে খালুর কাছে মানুষ হয়েছেন, সেই খালুর মৃত্যু খবর পেয়েও খেলা ছেড়ে যাননি। তার খালি একটা কথাই মনে হয়, ‘আমি না থাকলে চিৎকার করবে কে? বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় চার-ছয় মারলে, উইকেট পেলে তো সবাই চিৎকার করে। কিন্তু জানেন, যখন আউট হয় আমাদের কেউ বা কেউ চার-ছয় হজম করে; তখন গ্যালারি পুরো চুপ হয়ে যায়। এই সময়ে আমি চিৎকার করে চেষ্টা করি, সবাইকে চাঙ্গা রাখার’।
শোয়েবের কথার সত্যতা মেলে মাশরাফি, তাসকিনদের কণ্ঠে। তারা জানান দেন, খারাপ সময়তে অন্তত এই টাইগারের চিৎকার তাদের প্রাণশক্তিটা টিকিয়ে রাখে।