জামতলার মিষ্টি, জামতলার রসগোল্লা বা সাদেক গোল্লা। দেশের গন্ডি পেরিয়ে যার নাম ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রেখেছে যশোরের জামতলার এই মিষ্টি।
প্রতিদিন সহস্রাধিক জামতলার মিষ্টি তৈরি হয়, আর দুপুরের আগেই তা ফুরিয়ে যায়। যশোর শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের ছোট একটা বাজার জামতলায় তৈরি করা এই মিষ্টি নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই।
দেশের বেশিরভাগ রাষ্ট্রপ্রধান জামতলার মিষ্টি খেয়েছেন। বিদেশি অতিথিরাও জামতলার মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেছেন। জামতলার মিষ্টি শুধু জামতলায়ই তৈরি হলেও দোকান কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই মিষ্টি পাওয়া যায়। অনেকে এই মিষ্টি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণে নকল মিষ্টি বিক্রি করারও অভিযোগ শোনা যায়।
কী রয়েছে এই বিশেষ মিষ্টিতে? দেশি গরুর দুধ, উন্নতমানের চিনি আর জ্বালানি হিসেবে এক নাম্বার কাঠ এই মিষ্টি তৈরির মূল উপাদান বলে জানানো হয়। তবে কী মন্ত্র আছে তা জানা যায়নি!
১৯৫৫ সালে চায়ের দোকানদার মরহুম শেখ সাদেক আলী প্রথম এই মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। সাদেক আলীর একটি চায়ের দোকান ছিল। প্রতিদিন গোয়ালারা দোকানে গরুর দুধ দিয়ে যেত। একদিন দুধের পরিমাণ বেশি হলে সাদেক দুধ কিনতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এ সময় কুমিল্লা থেকে আসা এক ব্যক্তি সাদেককে জানান, দুধের মান খুব ভালো। তুমি দুধ রেখে দাও। আমি রাতে মিষ্টি তৈরি করে দেব। সেই দুধে মিষ্টি তৈরি শুরু। কুমিল্লার সেই ব্যক্তির কাছ থেকে শিখে সাদেক মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। মিষ্টির গুণাগুণের জন্য এক পর্যায়ে সেই রসগোল্লার নাম হয় সাদেক গোল্লা।
সেই ১৯৫৫ থেকে ১৯৯৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাদেক নিজ হাতে মিষ্টি তৈরি করে এর সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছেন। সাদেকের মৃত্যুর পর তার ছয় ছেলে আনোয়ার হোসেন, আলমগীর, শাহিনুর, শাহজাহান, জাহাঙ্গীর ও নূরুজ্জামান ব্যবসায়ের হাল ধরেন।
জামতলায় এখন সাদেক গোল্লার একে একে গড়ে উঠেছে তিনটি দোকান। আর একটি সাদেক আলী মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে আনোয়ার হোসেনের তত্ত্বাবধায়নে নাভারন বাজারের সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রয়েছে। এছাড়া নাভারন বাজারে রয়েছে একটি। জামতলা বাসস্ট্যান্ডের বটতলায় রয়েছে আদি সাদেক আলীর প্রতিষ্ঠিত ‘সাদেক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। পরবর্তী সময় আরও তিন ভাই দুটি দোকান প্রতিষ্ঠিত করেছে জামতলায়।
প্রতিদিন সহস্রাধিক মিষ্টি এখানে বিক্রি হয়। সময়ের বদলে সাদেক গোল্লা কর্তৃপক্ষ ৪ প্রকারের প্যাকেটে মিষ্টি সরবরাহ করে থাকেন। এর মধ্যে ৫ টাকা দরের ২০ পিস, ১০ টাকা দরের ১০ পিস ও ২০ টাকা দরের ৫ পিসের পলিথিনের প্যাকেটে থাকে। এ ছাড়া সম্প্রতি সাদা রংয়ের আরও নতুন একটা মিষ্টি তারা উদ্ভাবন করেছেন। এতে রয়েছে ২০ পিস, যার বাজার দর করা হয়েছে ১২০ টাকা।
মরহুম সাদেকের ছেলে শাহিনুর রহমান আদি জামতলার ‘সাদেক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ পরিচালনা করছেন। তারা জানিয়েছেন, জামতলা ও বড় ভাই আনোয়ার হোসেন নাভারনে ছাড়া আমাদের আর কোথাও মিষ্টির দোকান নেই। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জামতলার মিষ্টি আমরা সরবরাহ করে থাকি। তবে আমাদের নামে বাজারে অনেকেই মিষ্টি তৈরি করে জামতলার মিষ্টি বলে চালিয়ে যাচ্ছেন। তার স্বাদের সঙ্গে আমাদের তৈরি করা মিষ্টির স্বাদের ব্যবধান রয়েছে।
মিষ্টির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তারা জানান, হালকা মিষ্টি। স্পঞ্জ রসগোল্লা, বাদামি রং। মূল বিষয় হচ্ছে, এই মিষ্টি দেশি গরুর দুধ দিয়ে তৈরি। ভালো চিনি এবং তেঁতুল, বাবলা বা বেলকাঠের জ্বাল ছাড়া আর কোনও মন্ত্র নেই।
দোকানের একজন পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, ২০১৩ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরে এলে আমাদের এখান থেকে সেনাবাহিনী মিষ্টি নিয়ে গেছে। হাসিনা, খালেদা ও এরশাদসহ বিদেশি রাষ্ট্রীয় মেহমানরা আমাদের মিষ্টি খেয়েছেন। আমেরিকা, দুবাই, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ভারত, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও জাপানে অনেকেই এখান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে যান। তাদের ভাষ্য, চুলা ও পাত্র অন্যত্র নিয়ে গেলে এই মিষ্টির স্বাদ থাকবে না। তিনি আরও জানান, সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখন আমরা জামতলার মিষ্টির একটি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে পারি।
তথ্যসূত্র : অনলাইন