বছর ঘুরে আবার দ্বারপ্রান্তে নতুন বছর ২০১৮। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুনকে স্বাগত জানানোর যে রীতি চলে আসছে তাই নববর্ষ হিসেবে সামনে আসে। বাংলাদেশে সাধারণত তিনটি বর্ষের প্রচলন রয়েছে, যা হলো- ইংরেজি, বাংলা ও হিজরি। এসব বর্ষের আবার সুর্দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ইংরেজি নববর্ষকে সামনে রেখে তাই এই বর্ষ কিভাবে এলো একটু জেনে নেওয়া যাক।
প্রকৃতঅর্থে আমরা যে ইংরেজি সাল বা খ্রিস্টাব্দ মেনে চলি তা হলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ইংরেজি নববর্ষ পালন করা হয়। এই ক্যালেন্ডার নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। বর্তমানে মতো অনেক আগে সার্বজনীনভাবে পহেলা জানুয়ারি নববর্ষের প্রচলন ছিলো না। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রকৃতভাবে একটি সৌর বছর। আর বর্তমানের যে ক্যালেন্ডার তাতে পৌঁছাতে কয়েক’শ বছর সময় লেগেছে।
ইতিহাসে রয়েছে, মানুষ প্রথমদিকে চাঁদের হিসেবেই নতুন বর্ষ গণনা শুরু করে। চাঁদের হিসেবে ১০ মাসে বছর হতো। সেখানে ঋতুর সাথে কোনও সম্পর্ক ছিলোনা। সূর্যের হিসাবে বা সৌর গণনার হিসাব আসে অনেক পরে। সৌর এবং চন্দ্র গণনায় আবার পার্থক্য রয়েছে। সৌর গণনায় ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে।
প্রায় ৪০০০ বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে মেসোপটেমীয় (ইরাক) সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়েছিলো। মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আবার ৪টি আলাদা ভাগ আছে, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আসিরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়।
সে সময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালন করা হতো এই বর্ষবরণ। তবে সেটা কিন্তু এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না। তখন নববর্ষ পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তকালে প্রকৃতির নতুন করে জেগে ওঠাকেই তাঁরা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করেছিলো। তখন তাঁরা চাঁদ দেখেই বছর গণনা করতো। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো তাদের বর্ষবরণ উৎসব, চলতো টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের আবার আলাদা আলাদা তাৎপর্যও ছিল। ব্যা
বিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন করা শুরু করে রোমানরা। রোমের উপাখ্যান খ্যাত প্রথম সম্রাট রোমুলাসই ৭৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান ক্যালেন্ডার চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য এই ক্যালেন্ডারও রোমানরা চাঁদ দেখেই বানিয়েছিলেন। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ ছিলো ১ মার্চ। সেই ক্যালেন্ডারে মাস ছিল মাত্র ১০টা। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। সমস্যা ছিল আরও, রোমানদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিল না। ধীরে ধীরে চাঁদের বেড়ে উঠার ছবি দিয়ে তারা মাসের বিভিন্ন সময় চিহ্নিত করতো। চাঁদ ওঠার সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলতো ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলতো নুনেস। পরে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের ঝামেলা শেষ করে বসিয়ৈ দেন তারিখ। ফলে বছরে মোট ৩৫৫ দিন হয়। যেহেতু চাঁদের হিসাবে প্রতিমাসে দিন হয় সাড়ে ২৯। আর তাই চাঁদের হিসাব করায় তাদের বছরে ১০ দিন কম থেকে গিয়েছিলো। এইভাবে বছর হিসাবের ফলে চাষীরা সমস্যায় পড়ে যায়। পরে অনেক চিন্তা ভাবনা করে সম্রাট সিজার চাঁদের হিসাব না করে, সূর্য দিয়ে হিসাব করে বছরকে ৩৬৫ দিনে এনে এই সমস্যার সমাধান করেন।
অনেকে বলেন সেই সময়ে সূর্য দেখে প্রথমে ৩৬৫ দিনের নয়, ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন! রোমান সম্রাট জুলিয়ান সিজার লিপইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে গ্রিক জ্যোতির্বিদ মোসাজিনিসকে নিয়ে আসেন ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য। মোসাজিনিস দেখতে পান পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিন করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ঘন্টা। ৩৬৫ দিন বছর হিসাব করা হলে এবং প্রতি চতুর্থ বছরে ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করলে হিসাবের কোন গড়মিল হয় না। আর তাই মোসাজিনিস অতিরিক্ত একদিন যুক্ত করে এ বছরটির নাম করেন ‘লিপিইয়ার’।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ঠিক করা হয়েছিলো বর্ষবরণ হিসেবে পালন করা হবে ২৬ মার্চ তারিখটি। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে মানা হচ্ছিলো না। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস যখন জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে স্থান দেন, তিনি ঠিক করে দেন জানুয়ারির ১ তারিখ হলো বছরের প্রথম দিন। ওইদিনই হবে বর্ষবরণ। কিন্তু সে কথাও মানা হলো না। রোমানরা সেই আগের মতো মার্চের ১ তারিখেই বর্ষবরণ উৎসব করতে লাগলেন। পরে জুলিয়াস সিজার যখন ৩৬৫ দিনে বছরের ঘোষণা দেন, তখন আবার বলে দেন মার্চে নয়, বছর শুরু হবে জানুয়ারির ১ তারিখে। উৎসবও সেইদিনই হবে। এরপরই বর্ষবরণ উৎসব মার্চ মাস থেকে চলে এলো জানুয়ারিতে। সেইসময়ে রোমান সাম্রাজ্যে এই ক্যালেন্ডার নিয়ে অনেক রকম ঝামেলা হয়েছিলো। আর তাই কবে যে নতুন বছর শুরু হবে, সেটা ঠিকই করা যাচ্ছিল না। একেক সময় একেক জায়গায় একেক দিন নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালিত হতো।
সিজারের ক্যালেন্ডারেও বেশকিছু সমস্যা ছিলো। এই সমস্যার সমাধানে মাত্র ৪০০ বছর আগে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের পরামর্শ নিয়ে ক্যালেন্ডারটির সংস্কার করেন। তারই নাম অনুসারে ক্যালেন্ডারটির নামকরণ করা হয়েছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আর এটি বের করার পর এর সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে সকল জাতিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে। ফলে আগে যারা নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষবরণ উৎসব পালন করতো, তারাও এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানুয়ারির ১ তারিখই নববর্ষ হিসেবে পালন করে।
একই দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানালেও বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালনের রীতিনীতিও ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কিছু মিল থাকলেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হয় দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। গ্রেট ব্রিটেনে এই গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার প্রচলিত হয় ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে। আর এই ক্যালেন্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। আমরাও পহেলা বৈশাখের পাশাপাশি প্রতিবছর ১লা জানুয়ারিতেও বর্ষবরণ করি। এদিনও আমরা সারারাত আনন্দে মেতে উঠি। মেতে উঠি ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যতায়। যেহেতু প্রাচীন রোমানদের হাতেই এই ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি আর তাই ইংরেজী বছরের বারটি মাসের বেশীর ভাগই নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবতা বা সম্রাটের নামানুসারে।
জানুয়ারি-রোমান দেবতা জানো’স এর নামানুসারে ।
ফেব্রুয়ারি-ল্যাটিন শব্দ ফেব্রুয়া থেকে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ পবিত্র
মার্চ-রোমানদের যুদ্ধ দেবতা মার্সের নামানুসারে
এপ্রিল-ল্যাটিন শব্দ এপ্রিলিস নামানুসারে, যার অর্থ খোলা
মে-বসন্তের দেবী মায়া’স নামানুসারে
জুন-বিবাহ এবং নারী কল্যাণের দেবী জুনো’র নামানুসারে
জুলাই- রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার-এর নামানুসারে
আগষ্ট-জুলিয়াস সিজারের পুত্র অগাস্টাস সিজারের নামানুসারে
সেপ্টেম্বর-ল্যাটিন সপ্তম সংখ্যা সেপ্টেম এর নামানুসারে
অক্টোবর- ল্যাটিন অষ্টম সংখ্যা অক্টো এর নামানুসারে
নভেম্বর- ল্যাটিন নবম সংখ্যা নভেম এর নামানুসারে
ডিসেম্বর- ল্যাটিন দশম সংখ্যা ডিসেম এর নামানুসারে
পরিশেষে, এসেছে নতুন বছর। তাই পুরাতনকে ভুলে আমাদের ভেতরের খারাপ দিকগুলোকে রুদ্ধ করে নতুন উদ্যমে ভালো কিছু করার, ভালো থাকার ও সকলকে ভালো রাখার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত