ঘোড়ার আগে গাড়ি, নাকি সাইকেলে হেলিকপ্টারের পাখা লাগানো—কী বলব একে? সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) বসানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকার বিশাল ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৬৩টি বিদ্যালয়ে এই এস্কেলেটর স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একনেকে প্রকল্পটি পাসও হয়েছে। এর নাম উন্নয়ন। কিন্তু শিক্ষকের অভাব, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, শিক্ষা উপকরণের অভাব সব কি মিটে গেছে? শিক্ষার মানের কী অবস্থা? আসুন তা দেখি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং বিভাগ দুই বছর পরপর একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার নাম ন্যাশনাল স্কুল অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট, সংক্ষেপে এনএসএ। সারা দেশের শিক্ষার্থীদের থেকে নমুনা নিয়ে তাদের যোগ্যতাভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে দেখা হয়, শিক্ষার্থীরা প্রকৃতপক্ষে কোথায় অবস্থান করছে। সর্বশেষ প্রতিবেদন ২০১৫ সালের। সেই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলায় শতকরা মাত্র ২৯ ভাগ শিক্ষার্থী শ্রেণি অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারে এবং গণিতে শতকরা ৩২ জন শিক্ষার্থী শ্রেণি অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। শ্রেণি যোগ্যতা মানে যে ক্লাসে যতটুকু পারা উচিত। তার মানে উল্টো করে বললে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলায় শতকরা ৭১ ভাগ শিশুই তার যতটুকু পারা উচিত, তা পারে না। আর গণিতে শতকরা ৬৮ ভাগ শিশুই তার যেটুকু পারার কথা, তা পরে না।
এখন আমার সরল প্রশ্ন, এই যে বাংলা ও গণিতে ৭০ শতাংশ শিশু প্রায় কোনো কিছু না শিখেই যে মাধ্যমিকে উঠছে, মাধ্যমিকের বিদ্যুৎ-চালিত সিঁড়ি বানিয়ে দিলে কি আমাদের এসব শিক্ষার্থী বাংলা ও গণিতে যোগ্যতা অর্জন করে ফেলবে? যদি তা না হয়, তাহলে আসলে এই ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ের বৈদ্যুতিক সিঁড়ির কী কাজ থাকতে পারে? বেসিক নিউমারেসি ও লিটারেসি হচ্ছে প্রাথমিক গুনতে পারা এবং পড়তে-লিখতে পারা, একটি শিশুর শিক্ষিত হওয়ার প্রথম ও প্রধান ধাপ। সেই ধাপকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে কৃত্রিম বৈদ্যুতিক ধাপ দিয়ে আসলে মাধ্যমিকে আমরা কী অর্জন করতে চাইছি?
২০১৬ সালের কথা। ঢাকার পাশে মানিকগঞ্জের এক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখি দপ্তরি ক্লাস নিচ্ছেন। কী বিষয়, প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ভদ্রমহিলার বিধ্বস্ত অবস্থা। এই দপ্তরি আর একজন শিক্ষককে নিয়ে পুরো বিদ্যালয় সামাল দিতে হচ্ছে। মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৩০০। সরকারি হিসাব অনুযায়ী কমপক্ষে চারজন শিক্ষক থাকার কথা। কেন শিক্ষক নেই? একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে, আরেকজনকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। আপনি বদলি শিক্ষক চাননি? বদলি শিক্ষক চাইতে চাইতে উনি ক্লান্ত। লিখিতভাবে, ফোন করে, যতভাবে চাওয়া যায়। কিন্তু ওনার কথায় কর্ণপাত করার লোক কোথায়?
২০০৯ সালের কথা। সিরাজগঞ্জের চরের ভেতর এক সরকারি বিদ্যালয়ে গেছি। একজন মাত্র শিক্ষক মাঠের মাঝখানে বেত নিয়ে বসে আছেন, আর তিনটা ক্লাসে তারস্বরে চিৎকার করে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করছে। আর কোনো শিক্ষক নেই। কী বিষয়। এই বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ঠিক করে নিয়েছেন, কে কবে বিদ্যালয়ে আসবেন। সপ্তাহে দুই দিন করে ভাগ করে নিয়েছেন। যেহেতু চরের ভেতর অনেক প্রত্যন্ত এলাকার একটা বিদ্যালয়, দুই ঘণ্টা ধরে হেঁটে যেতে হয়, শিক্ষকেরা শহর থেকে নিজেদের মতো করে এই ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। দেখার কোনো লোক নেই।
শিক্ষকস্বল্পতা এইটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা না। এটাই হচ্ছে বিদ্যালয়গুলোর গড়পড়তা চিত্র।
বাংলাদেশের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আপনাদের? না থাকলে আমি একটু ধারণা দিই। কটকটে হলুদ রঙের চার কামরার একটা বিল্ডিং, যার তিনটেতে ক্লাস হওয়ার কথা আর একটা অফিস ঘর কাম প্রধান শিক্ষকের বসার ঘর। এটা সরকার থেকে পাস হওয়া নকশা। যেসব এলাকায় ঘূর্ণিঝড় কিংবা বন্যা হয়, সেসব জায়গায় নিচে খুঁটি দিয়ে এই চারটা কামরাকে ধাক্কা মেরে আট ফুটের মতো ওপরে তুলে দেওয়া হয়। ব্যস, এইটুকুই। সারা দেশেই একই চিত্র। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে নিম্নমানের স্থানীয় ইট-সুরকি ব্যবহার করায় পলেস্তারা খসে খসে পড়ে। সব মিলে প্রতিটা ক্লাসে ১২ থেকে ২০টা বেঞ্চ থাকে, যার অনেকগুলোই ভাঙা। একটা সুরকি ওঠা ব্ল্যাকবোর্ড। সরকারেরই নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি শিশুর পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার কথা। আমি এ রকম অসংখ্য শিশু পেয়েছি, যারা প্রতিদিন কমপক্ষে এক থেকে দুই ঘণ্টা হেঁটে বিদ্যালয়ে আসে। তার মানে এই শিশুগুলোর পাঁচ কি দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিদ্যালয় নেই।
পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থা তো আরও খারাপ। শুধু পাহাড় ডিঙিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয় বলে কত শিশু বিদ্যালয়েই আসতে পারে না। সরকারি কেন, বেসরকারিও কোনো হিসাব নেই এই শিশুগুলোর। অসংখ্য বিদ্যালয় আছে, দপ্তরি নেই। প্রধান শিক্ষক দপ্তরির কাজ করেন। আর অফিসের কাজ করার জন্য তো কোনো পদবিই নেই। প্রধান শিক্ষককেই তাঁর সহকর্মী নিয়ে ভোটের কাজ থেকে শুরু করে বৃত্তির কাজ, শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন তথ্য প্রদান—সব কাজ একাই করতে হয়। এর ওপর আবার আছে ক্লাস্টার মিটিংয়ে অংশগ্রহণ অথবা সরকারি কর্মকর্তাদের ডাকে সাড়া দেওয়ার কাজ। ক্লাস নেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে শেষের প্রায়োরিটি। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এক শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ৪৫ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা। অথচ কক্সবাজারে এ সংখ্যা ৮০ আর রংপুরে ৬৪। কেন? কারণ, শ্রেণিকক্ষের অভাব, কিন্তু ছাত্রছাত্রী বেশি।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আওতার মধ্যের সব শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে হবে, কিন্তু সরকার জায়গা করে দেবে না। অসংখ্য বিদ্যালয় আছে, যেখানে টিউবওয়েল নেই, বাথরুম নেই। বাথরুম থাকলে বালতি নেই, বদনা নেই। শিক্ষকদের হাত ধোয়ার সাবান পর্যন্ত থকে না। শিক্ষকেরা যে কলম ও কাগজ ব্যবহার করেন, সেটাও খুব হিসাব করে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাস্টার নেই, চক নেই। বাচ্চাদের জন্য আকর্ষণীয় পড়ার উপাদানের কথা তো বাদই দিলাম। যেটুকু না হলে একটা শিশু স্রেফ অক্ষরজ্ঞানটাও পাবে না, আমি শুধু সেটুকুর কথা বললাম। আমি এ রকম অসংখ্য শিশু পেয়েছি, যারা সেই সাতসকালে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসে। সারা দিন না খেয়ে ক্লাস করে। শেষ বেলায় বাড়ি ফিরে দুটো খায়। আমার সামনেই মানিকগঞ্জে অ্যাসেম্বলিতে একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। শিক্ষক অসহায়ের মতো বললেন, ‘কী করবে বলেন, না খেয়ে স্কুলে আসে।’ মিডডে মিল বা দুপুরের খাবার কী জিনিস, তা নিয়ে আমাদের সরকারের কোনো ধারণাই নেই। সেই আমরাই মাধ্যমিকে এক হাজার কোটি টাকা খরচ করে বৈদ্যুতিক সিঁড়ির কথা ভাবি। এ লজ্জা কোথায় রাখি!
দিলশানা পারুল: শিক্ষা গবেষক এবং বাস্তবায়ন কর্মী।
লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’য় প্রকাশিত