জিন বা ডিএনএ’তে পরিবর্তন এনে জীবের স্বভাব চরিত্র বদলে দেওয়া ! ব্যাপারটা শুনতে কিছুদিন আগেও সায়েন্স ফিকশনের মতো লাগতো। কিন্তু এখন রীতিমতো ডাল-ভাত হয়ে গেছে। শুধু তাই না, সেই ‘ডালভাত’আমরা খাচ্ছিও।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে যেসব খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, তাদের বলা হয় জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড ফুড ( Genetically modified food) । বিভিন্ন খাবারে বিভিন্ন কারণে জিনের পরিবর্তন আনা হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কারণটা হয় উৎপাদন বাড়ানো, গুণ, মান বা স্বাদ বাড়ানো বা আগাছা ও পোকামাকড় থেকে খাবার রক্ষা করা।
প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি এসব খাবারের সবসময় স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। মূল খাবারের অনেক পুষ্টি গুণ তো হারায়-ই, অনেক ক্ষতিকর উপাদানও যোগ হতে পারে। যেকারণে বেশ কিছু দেশে জিএম খাদ্য উৎপাদন নিষিদ্ধ ।
তারপরও জিএম খাদ্যের উৎপাদন থেমে নেই। চলুন জেনে নেই সবচেয়ে বেশি জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড সাত খাদ্যের কথা।
তুলা
তুলা আবার খায় কিভাবে ! প্রকৃতির এই চমৎকার উপাদানটিকে শুধু কাপড়-চোপড়ের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি নন বিজ্ঞানীরা।
২০০৬ সালে তাই যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির সাথে কটন ইনকর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান মিলে শুরু করে তুলাকে ভোজ্য করে তোলার কাজ। এজন্য প্রধান বাধা ছিল তুলার বীজে থাকা গসিপল ( Gossypol ) নামে একটি উপাদান, যা পোকামাকড়কে তুলা থেকে দূরে রাখে।
দীর্ঘ গবেষণার পর যে খাওয়ার যোগ্য তুলা পাওয়া গেছে, তার স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো ! অবশ্য খাদ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিয়ম-কানুন পার করে এই খাবার এখনও বাজারে আসতে পারেনি।
ধান
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের খাদ্য হচ্ছে ধান। অনেক আগে থেকেই ধানের জিনে পরিবর্তন এনে এর উৎপাদন সহজ করা, পুষ্টিগুণ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সাফল্য এসেছে অনেক পরে, ২০০০ সালের দিকে।
জিনে পরিবর্তন আনা সোনালি রঙের চালকে বলা হয় গোল্ডেন রাইস। মুশকিল হচ্ছে, এই চাল পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে বলে চীনের এক গবেষণায় জানা গেছে। তাই সম্প্রতি এটি নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক চলছে।এছাড়া সম্প্রতি ফিলিপাইনে আরেক ধরনের জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড রাইসের গবেষণা সফল হয়েছে, যা এতই শক্তিশালী যে বন্যার পানি প্রতিরোধ করতে পারে !
সয়াবিন
যুক্তরাষ্ট্রে মোট উৎপাদিত সয়াবিনের ৯০ শতাংশ জিন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উৎপাদিত হয়। বলা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড খাদ্য হচ্ছে সয়াবিন। পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে সয়াবিন রক্ষা করার জন্যই মূলত এর জিনে পরিবর্তন আনা হয়। এছাড়া এটি ওষুধ তৈরিতে লাগে, সেকারণেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়।
তবে পরিবর্তিত জিনের সয়াবিনে পুষ্টিজনিত বেশ কিছু সমস্যা থাকতে পারে। অ্যালার্জি থেকে শুরু করে ভিটামিনের অভাব, সাধারণত শরীর বৃত্তীয় কাজের ব্যাঘাত ইত্যাদি হতে পারে।
ইস্ট
কেক বা পাউরুটি থেকে শুরু করে যেকোনো বেকারি খাবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ইস্ট। ইস্ট কিন্তু আসলে এক ধরণের ছত্রাক, যাকে বিশেষ ভাবে খাবারে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। কেকের ফেঁপে ওঠা ও স্পঞ্জের মতো নরম করার কৃতিত্ব ইস্টের।
স্যানফ্রান্সিসকোর এলএস ৯ নামে একটি কোম্পানি ইস্টের ডিএনএতে এমনই পরিবর্তন এনেছে যে এটি ফসলের মতো মাঠে চাষ করা যাবে! বলতে গেলে ছত্রাকের চাষ আর কি !
দুধ
সবচেয়ে বিতর্কিত জেনেটিক্যালি মোডিয়ফায়েড ফুডের মধ্যে অন্যতম দুধ। গরুর দুধ দেওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য আরবিজিএইচ (rBGH) বা রিকম্বিনেন্ট বোভিন গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা হয়। দুধ উৎপাদনকারী কোষগুলোকে এটি বাধ্য করে কম সময়ে বেশি দুধ দেওয়ার জন্য। দুধের উৎপাদন ১৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব এভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাঁচটি গরুর একটির জিনে এ পরিবর্তন আনা হয়।
তবে এই হরমোনের কারণে দুধে আইজিএফ-১ (ইনসুলিনগ্রোথ ফ্যাক্টর-১) নামে একটি উপাদান দেখা যায় যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ জাপান, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় তাই গরুর জিনে পরিবর্তন আনা নিষিদ্ধ।
বিটরুট
বিটরুট দেখতে ও স্বাদের দিক দিয়ে অনেকটাই মূলার মতো। এই খাবারের জিনে পরিবর্তন এনে স্বাদ থেকে শুরু করে উৎপাদন পদ্ধতি—সবই বদলে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত চিনির অন্যতম উপাদান মিষ্টি বিটরুট। সাধারণ বিটরুটের জিন বদলে সেখানে মিষ্টি বিটরুট করা হচ্ছে। বিটরুট ক্ষেতে গ্লাইফোসেট (Glyphosate )নামে এক ধরনের আগাছা হয়। ওই আগাছার জিন সরিয়ে ফেলায় একই জায়গায় বেশি ফলন হচ্ছে।
এছাড়া বিটরুটের সৌন্দর্য বাড়াতেও জিনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে ! জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন এর আকার কেমন হবে। পাশের ছবিতে সাধারণত বিটরুট ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া আকারের বিটরুট দেখা যাচ্ছে।
পেঁপেঁ
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আর উদ্ভিদ গবেষক ডেনিস গঞ্জালভেস( Dennis Gonsalves ) না থাকলে বিশ্বে এখন পেঁপেঁর রীতিমতো অভাব থাকতো। পেঁপেঁ নিয়ে প্রায় ৩০ বছর গবেষণাকারী এই বিজ্ঞানী নব্বইয়ের দশকে রিংস্পট ভাইরাসের হাত থেকে পেঁপেঁর বংশকে রক্ষা করেন জিনে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে। এই ভাইরাসের প্রকোপে উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে পেঁপেঁর ফলন আশংকাজনক হারে কমতে শুরু করেছিল। বর্তমানে বিশ্বে উৎপাদিত মোট পেঁপেঁর চার ভাগের তিনভাগই জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড।