ইউরেকা! ইউরেকা!

একটা পরিচিত গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। প্রাচীন গ্রিসের অন্তর্গত ছোট্ট দ্বীপ সিসিলি। তাতে বিখ্যাত শহর সিরাকিউজ। সিরাকিউজের রাজা ছিলেন হিরো। তিনি প্রতিবার যুদ্ধে জয় করতেন আর দেব-দেবীর নামে বিরাট বিরাট সব উপহার উৎসর্গ করতেন।তো একবার ঠিক করলেন যে দেবীর নামে স্বর্ণের মুকুট উৎসর্গ করবেন।

স্বর্ণকারকে মুকুট তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হল। খুব সুন্দর করেই ঝলমলে একটা মুকুট বানিয়ে দিল স্বর্ণকার। কিন্তু হিরোর মন থেকে সন্দেহ যায় না। সত্যিই সম্পূর্ণ সোনা দিয়ে বানানো তো? স্বর্ণকার ব্যাটা কিছু মেরে দেয়নি তো?

দরবারের বিশ্বস্ত এক বিজ্ঞানপাগল বন্ধুকে তার সন্দেহের কথা খুলে বললেন হিরো। বলা বাহুল্য, সেই বন্ধু কয়েক দিনের মধ্যেই সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির!

এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন কে সেই মহান বিজ্ঞানী? আচ্ছা তিনি কিভাবে সমস্যাটার সমাধান করলেন তা একটু পরে বলা যাক। আগে এই বিজ্ঞানী বন্ধুর পরিচয়টা ভালভাবে জেনে নিই।

প্রাচীন গ্রিসে সবাইকে বিজ্ঞানী বলা হতো না। যারা খুব জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলতেন এবং জ্ঞানী জ্ঞানী তত্ত্ব দিতেন, শুধু তাদেরই বিজ্ঞানী বলা হতো। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো সাধারণ মানুষের খুব কমই কাজে লাগতো।কিন্তু এই‘বিশেষ ধরনের জ্ঞান’ বিজ্ঞানকে যে আমাদের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও ব্যবহার করা যায়, তা প্রথম চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মহামতি আর্কিমিডিস। 

ইতিহাসের এই অন্যতম খেয়ালী বিজ্ঞানী খ্রিস্টপূর্ব ২৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, তিনি বিজ্ঞানকে এমনভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন যে সবাই ভাবতে শুরু করেছিল আর্কিমিডিস সব অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারেন। অসংখ্য গাণিতিক তত্ত্ব ও মৌলিক কিছু যন্ত্রপাতির জনক তিনি। বিজ্ঞানকে যারা হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখিয়েছেন, তাদের মধ্যে আর্কিমিডিসের নাম ওপরের দিকে থাকবে। 

এই যেমন লাঠি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তিনি ধারণা দিলেন লিভার(Liver) এর ধর্ম সম্পর্কে। তিনি খেয়াল করেছিলেন, লিভারের সাহায্যে অনেক ভারি জিনিসপত্রখুব সহজেই ওঠানো বা নড়ানো যায়। এর কিছু বাস্তব প্রয়োগ দেখালেন মানুষকে। লিভার নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে তৈরি করে ফেলেন পুলি। পুলির আবিষ্কার প্রাচীন প্রযুক্তিকে এক ধাক্কায় অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিল। পুলি দিয়ে সুবিশাল জাহাজ নাড়াচাড়া করে দেখিয়েছিলেন তিনি।

গ্রিস-রোমের যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য আর্কিমিডিস বানিয়েছিলেন আরও অনেক ধরনের যন্ত্র। রোমানরা যখন সিরাকিউজ আক্রমণ করে, তখন  আর্কিমিডিসও নেমে পড়েছিলেন যুদ্ধে; তাঁর ঢাল ও তলোয়ার দুই-ই ছিল তাঁর মস্তিষ্ক!

আর এতেই নাজেহাল রোমানরা! সিরাকিউজ নগরীর পাঁচিলের ওপর দড়ি বাঁধা থাকতো। দড়ির প্রান্তে বাঁধা থাকতো বড় বড় লোহার আংটা। সেগুলো রোমানদের জাহাজে গিয়ে জায়গামতো লাগতো, সাথে সাথে ওপ্রান্ত থেকে কপিকলের সাহায্যে দেওয়া হত হ্যাঁচকা টান। ব্যস, উলটে যেত আস্ত জাহাজ! পাঁচিলের অন্য পাশে বসে মুচকি মুচকি হাসতেন আর্কিমিডিস।

আবার কখনো কখনো অনেক আয়না সাজানো থাকতো। সেগুলো দিয়ে সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে এক জায়াগায় ফেলা হতো, সেখান থেকে তাক করা হতো শত্রু জাহাজের দিকে। দাউ দাউ করে আগুন ধরে যেত জাহাজে!

জাহাজ থেকে পানি সেঁচে ফেলার জন্য আর্কিমিডিস একধরনের যন্ত্র বের করেছিলেন, যা ‘আর্কিমিডিস স্ক্রু’ নামে পরিচিত। সেই যন্ত্র আজো অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়।

আর্কিমিডিস পড়ালেখা করেছিলেন মিশরের বিখ্যাত নগরী আলেকজেন্দ্রিয়ায়। তখনকার দিনে এ নগরীটি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের চারণক্ষেত্র। প্লেটো, ইউক্লিডের মতো নামি-দামী বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্য তিনি সেখানেই পেয়েছিলেন।

ক্যালকুলাসের জনক স্যার আইজ্যাক নিউটনকে বলা হলেও আর্কিমিডিসই প্রথম আমাদের ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাস সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছিলেন। আঁকাবাকা কোনো ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল বের করার জন্য একে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ করেছিলেন। পরে আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকটি ভাগের ক্ষেত্রফল বের করে সব গুলো যোগ করে সমাকলন বা ইন্টিগ্রেশন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আবার, পাই (π) এর মান বের করার পদ্ধতিও প্রথম বের করেছিলেন তিনিই। আমরা জানি যে কোনো বৃত্তের পরিধিকে তার ব্যাস দিয়ে ভাগ দিলে ‘π’ (পাই) এর মান পাওয়া যায়। তবে বৃত্তের পরিধির দৈর্ঘ্য বের করা কিন্তু খুব সহজ কথা নয়! আর্কিমিডিস এর জন্য কি করেছিলেন, দেখা যাক।

প্রথমে আমরা একটি বৃত্ত নিই। এর মাঝে একটি সমবাহু ত্রিভুজ আঁকি। এবার যদি ত্রিভুজের পরিধি পরিমাপ করা হয়, তবে তা বৃত্তের পরিধির চেয়ে অনেক ছোট হবে । কিন্তু এখন যদি ত্রিভুজ না এঁকে ষড়ভুজ আঁকা হতো তাহলে কি দাঁড়াতো? এর পরিসীমা বৃত্তের কাছাকাছি হতো।

এ থেকে বুঝতে পারা যায়, ভুজ বা বাহু যত বাড়ানো হবে তার পরিসীমা ততই বৃত্তের কাছাকাছি হবে। এভাবে আর্কিমিডিস ৯৬ টা বাহু বিশিষ্ট বহুভুজ (polygon) এঁকেছিলেন। এরপর একে ব্যাস দিয়ে ভাগ দিয়ে বললেন,π মান ২৪৩/৭০ থেকে বড়। একই ভাবে তিনি বৃত্তের বাইরেও এরকম আঁকলেন, এবং বললেন যে π এর মান ২২/৭ থেকে ছোট। এবং ব্যাপারটা আসলেই তাই!

Also Read: পাই (π) এর ইতিকথাঃ পর্ব ১

শুরুতে রাজা হিরোর একটা সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলাম, সেটা শেষ করি। আর্কিমিডিস রাজার মুকুট নিয়ে সমস্যাটা বোঝার পর চিন্তামগ্ন হয়ে গেলেন। দিনরাত শুধু সেটা নিয়েই ভাবতে থাকলেন।

তো এমন সময় একদিন তিনি গোসলের জন্য চৌবাচ্চায় নেমেছেন। পানিতে নামতে নামতেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলেন। হঠাৎ করেই বিদ্যুৎঝলকের মতো সমাধানটা তাঁর মাথায় এলো।আর পায় কে! দিগম্বর অবস্থায়ই গোসলখানা থেকে বেরিয়ে এসে ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে চিৎকার করতে থাকলেন।

এতোটা খামখেয়ালি বিজ্ঞানী বোধহয় ইতিহাসে দুর্লভ!

আর্কিমিডিসের সমাধানটা ছিলো এমন- তিনি যখন চৌবাচ্চায় নামতে থাকেন তখন খেয়াল করেন যে তিনি যত গভীরে নামছেন পানি তত উপচে পড়ছে। মানে শরীরের যতোটুকু ডুবছে ততো পানি সরে যাচ্ছে। এবং পানিতে নামার পর নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।

এতে তিনি দুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। প্রথমত, কোনোবস্তুকে পানি বা যেকোনো তরলে (অথবা গ্যাসে) ডোবালে তা তার আয়তনের সমান পানি অপসারণ করে। দ্বিতীয়ত, যতটুকু পানি অপসারিত হয় সে পরিমাণ ওজন কমে যায়।

অর্থাৎ দুটি বস্তুর ভর সমান হলেও যদি ঘনত্ব আলাদা হয় তাহলে যার ঘনত্ব কম তার আয়তন বেশি হবে। সেক্ষেত্রে অপসারিত পানির পরিমাণ বেশি হবে এবং একইসাথে বেশি ওজন হারাবে।

Also Read: পানির প্লবতা 

এই নীতি থেকেই স্বর্ণে ভেজাল আছে কিনা তা বের করা যায়। সাধারণত স্বর্ণে ভেজাল হিসেবে রূপা মিশানো হয়। আর রূপার ঘনত্ব স্বর্ণের অর্ধেক। অর্থাৎ মুকুটে যদি ভেজাল থাকে, তাহলেওই একই ভরের স্বর্ণ পানিতে ডোবানো হলে খাঁটি স্বর্ণের ক্ষেত্রে কম এবং ভেজাল মিশ্রিত স্বর্ণের ক্ষেত্রে বেশি পানি অপসারিত হবে। সেক্ষেত্রে মুকুটের ওজন খাঁটি স্বর্ণের টুকরার ওজনের চেয়ে বেশ কমে যাবে। তাই মুকুট এবং একই ভরের খাঁটি সোনার টুকরা যদি দাড়িপাল্লার দুপাশে বাধা হয় তবে স্বাভাবিকভাবে পাল্লার কাঁটা ব্যালেন্সড থাকবে। কিন্তু পানিতে ডোবালে সেটা খাঁটি স্বর্ণের দিকে হেলে যাবে।

আর্কিমিডিসের এই আবিষ্কার যে ভুল নয় তা তিনি রাজাকে হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখালেন। তা দিয়ে বের করলেন, রাজার মুকুটে বেশ ভালো পরিমাণ খাদ ছিল। তারপর সেই স্বর্ণকারের কি অবস্থা হয়েছিল, তা আর না-ই বলি!

এই মহান বিজ্ঞানী শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছিলেন যুদ্ধাবস্থাতেই। দুই বছর ধরে রোমানরা সিরাকিউজ নগরকে ঘিরে রাখার পর অবশেষে ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেখানে প্রবেশ করতে পেরেছিল।ততোদিনে রোমান সেনানায়ক আর্কিমিডিস সম্পর্কে সব জানতে পেরেছিলেন। নগরীতে প্রবেশমাত্রই তিনি তাঁর সৈন্যদের হুকুম দেন আর্কিমিডিসকেযেন কোনো ক্রমেই আঘাত না করা হয় এবং জীবিত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়।

রোমান সেনারা যখন আর্কিমিডিসের ঘরে প্রবেশ করে, সেসময় তিনি বসে বসে বৃত্ত আঁকছিলেন। এক সেনা তাকে বলে যে সেনাপতি তাঁকে ডাকছেন। কিন্তু আর্কিমিডিস মনযোগী ছিলেন তাঁর গবেষণা নিয়ে, তাই তিনি বললেন, আমাকে বিরক্ত করো না। এহেন বেয়াদবি দেখে সেই সৈন্য ক্ষিপ্ত হয়ে সেখানেই আর্কিমিডিসকে মেরে ফেলে।

সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আর্কিমিডিস অমূল্য সব কীর্তির বেশিরভাগই কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে। অনেকেই বলে থাকেন আর্কিমিডিসের সব তত্ত্বের পুনরূদ্ধার করা হলে হয়তো পৃথিবী আরও ১০০ বছর আগেই আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পারতো!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন