একাত্তরের ২৫মার্চ কালরাতে

 

২৫ মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবনে মুক্তিকামী মানুষের ঢল। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পৃথক পৃথক মিছিল ভিড় জমায় ওই বাসবভনে। আর বঙ্গবন্ধু মিছিলের সামনে হাজির হয়ে স্বাধিকার আন্দোলন বেগবান করার নির্দেশ দেন। দুপুর ১২টার দিকেই বঙ্গবন্ধু খবর পান পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সহচরসহ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন।

সেদিন সকাল ১১টার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১টি হেলিকাপ্টারে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল ওমর, মেজর জেনারেল নজর, মেজর নাজির হোসেন শাহ, মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, লেফটেন্যান্ট জেনারেল খোদাদাদ খান ও মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা খান অন্যান্য স্টাফসহকারে রংপুর ২৩ ব্রিগেড সেনানিবাসে যান।

সেনানিবাসের প্রধান ব্রিগেডিয়ার আব্দুল আলী মালিক তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে সোজা তার বাসভবনে নিয়ে যান। সেখানে একমাত্র ইপিআর(বর্তমান বিজিবি) বাঙালি ক্যাপ্টেন ওয়াজিশকে ছাড়া সব ইউনিট কমান্ডদের নিয়ে ব্রিগেডিয়ার মালিক বৈঠক করেন। বৈঠকের কয়েক মিনিট পর হেলিকাপ্টার রংপুর ত্যাগ করে। হেলিকাপ্টারটি রাজশাহী, যশোহর, চট্টগ্রাম, ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে বিকালে ঢাকা ফিরে আসে।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে ‘ছক’ মোতাবেক পজিশন নেয় পাকিস্তানি সেনাবািহনীর গোলান্দাজ সাঁজোয়া ও পদাতিক বাহিনীর ৩ ব্যাটালিয়ন সৈন্য। ওই সময় বিদেশী সাংবাদিকরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) অবস্থান করছিলন। রাত ১১টার দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই হোটেল ঘিরে ফেলে। ২৫ মার্চ থেকে ঢাকার হোটেল ইন্টারকোন্টিনেন্টালে অবস্থানরত সকল সাংবাদিককে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২ দিন যাবত অবরুদ্ধ করে রাখে।

সেদিন সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। অপরদিকে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে। তিনি তার লিখিত পত্রে ঘোষণা করেন- ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।

ছাত্র জনতা পুলিশ ইপিআর শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র পতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি- আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিককে আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুুন। সম্মিলিতভাবে শত্রুর মোকাবেলা করুন। আপনার শেষ শত্রুটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।'

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে বার্তা আকারে পাঠানো হয়। ওই বাণীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য সমগ্র বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান করেন।' 

২৫ মার্চ মধ্য রাতে সেনা অভিযানের শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। মার্কিন ট্যাংকগুলো কামান উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সঙ্গে ট্রাক বোঝাই সৈন্য। প্রথমে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে। এতে মারা যায় নাম জানা অজানা শতাধিক ছাত্র। পাকিস্তানি সেনারা এরপর জগন্নাথ হলে ঢুকে সাবমেশিন দিয়ে গুলি করে হত্যা করে আরো কম্পক্ষে দেড় শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক।

ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম গণহত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। রোকেয়া হলও আক্রমণ থেকে বাদ দেয়নি হায়েনার দল। গুলি চালিয়ে হত্যা করে অসংখ্য ছাত্রীকেও। এ সময় অনেক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। এ রাতে ড. গোবিন্দ চন্দ্র, ড. জ্যোতির্ময় গুহা ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্রচার্য, অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯জন অধ্যাপককে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়।

সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়। এছাড়াও রাস্তার আশপাশের বস্তিবাসী ঘুমন্ত বাঙালি জনতাকে গুলি হত্যা করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হোস্টেলেও গুলি করে বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা।

রাস্তার আশপাশের কাঁচা আধপাকা স্থাপনাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানি হায়নারা। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যায় বস্তি, দোকানপাট। মুহূর্তের মধ্যে আগুনে লালে লাল হয়ে যায় ঢাকার আকাশ। হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর মর্মভেদী আর্তচিৎকারে ভারী হয় আকাশ-বাতাস। রাস্তায় রাস্তায় জমে উঠে লাশের স্তুপ।

কিন্তু এর মধ্যেও গড়ে উঠে প্রতিরোধ। পাকিস্তানি হায়নাদের প্রতিরোধ করা হয় রাজারবাগ, পিলখানায়। পিলখানা ই.পি.আর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করে ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা। বাঙালি ইপিআর সদস্যদের রক্তে রঞ্জিত হয় পিলখানার মাটি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিলখানার সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরেও পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমন চালায়।

প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনের দক্ষিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও তেজগাঁও থানা পুলিশের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রসরের খবর জানতে পেরে রাজারবাগের প্রায় চারশ পুলিশ সদস্য পজিশন নিয়ে তৈরি হয়েই ছিলো। আক্রমণের সাথে সাথে পুলিশ বাহিনীর হাতের সবগুলো রাইফেল এক সঙ্গে গর্জে উঠে। অবস্থার বেগতিক দেখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু সরে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেপরোয়া আক্রমণ চালায়।

বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কামান মর্টার গোলার জবাব দিচ্ছিলো। সেই ভয়াল রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পুলিশের এ.এস.আই. আসমত আলী, সুবেদার আবুল হাসেম, নায়েক মোহাম্মদ আলী, সার্জেন্ট মূর্ত্তজা প্রমুখ অশেষ বীরত্ব ও কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন। ভারী অস্ত্র ও পর্যাপ্ত গোলাবারুদ থাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ২৬ মার্চ ভোর বেলার মধ্যেই সমগ্র রাজারবাগ তাদের দখলে নিয়ে সক্ষম হয়।

২৫শে মার্চ রাতে গভর্নর হাউসে ই.পি.আর সৈন্য ছিলো ১১০জন। রাত ১২টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা তৎকালীন ডি.আই.টি. ভবনের ওপর থেকে গভর্নর হাউসে অবস্থানরত ই.পি.আর. বাহিনীর ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে।

ওই রাতে প্রেসিডেন্ট হাউসে ই.পি.আর বাহিনীর ২ কোম্পানি সৈন্য প্রহরারত ছিলো। সেদিন সন্ধ্যার সময় ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী প্রেসিডেন্ট হাউসে এসে জমা হতে থাকে। ই.পি.আর বাহিনীর সেক্টর অধিনায়ক(অবাঙালি)সন্ধ্যার পর প্রেসিডেন্ট হাউসে এসে বাহিনীর সব সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রেসিডেন্ট চলে গেছেন। তাই হাতিয়ার জমা করে প্রত্যেকের বিশ্রাম নেয়া উচিত। কিন্তু রাত ১১টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব বাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে অবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। নির্মম নির্যাতনে হত্যা করা হয় বাঙালি ইপিআর সদস্যদের।

শুধু বাঙালি পুলিশ-ইপিআর সদস্যরাই নয় সাধারণ জনতাও খালি হাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদ করেছিলো সেই রাতে খালি হাতে। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের অদূরে সাকুরা রেস্টুরেন্টের পেছনে 'দ্যা পিপল' সংবাদপত্রের অফিসের তৃতীয় তলায় রাতেই মিছিল বের করেন সাংবাদিকরা। তারা স্লোগান দেন, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ মুক্ত কর, বাঙালিরা এক হও’।

কাছেই অবস্থান করছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ ব্যাটালিয়ানের জওয়ানরা। তারা সঙ্গে সঙ্গে কামানের গোলা দিয়ে উড়িয়ে দেয় মুক্তিকামী মিছিলকারী সাংবাদিকদের। পরে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় ওই কাগজের অফিসে।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও ৩ হাজার মানুষকে। ঢাকায় ঘটনা মাত্র শুরু ছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন