ফোরজি ইন্টারনেট : আনন্দ-বেদনা

0
6710

ইন্টারনেট, বর্তমান জীবনযাত্রার এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ইন্টারনেটের ব্যবহার করছি আমরা। ডায়ালআপ থেকে ক্যাবল ব্রডব্যান্ড। এরপর টুজি থেকে থ্রিজি। এবার দেশে চালু হতে যাচ্ছে ফোরজি ইন্টারনেট সেবা। তবে সেবার মানের দিক থেকে আমরা কী পেয়েছি এবং কী পাওয়া উচিত সেটি নিয়ে আলোচনা করলে শেষ হবে না। তারপরেও একটু আলোকপাত করা যাক।

ফিরে দেখা
১৯৯০ সালের প্রথমদিকে বুলেটিন বোর্ড সিস্টেমস (বিবিএস) এর মাধ্যমে কয়েকটি স্থানীয় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ডায়ালআপের মাধ্যমে ইমেইল ব্যবহারের সুযোগ দেয়। সেই সময়ে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০০ পেরোতে পারেনি। গ্রাহকদের প্রতি কিলোবাইট হিসাব করে চার্জ করা হতো এবং তাদের প্রেরিত ইমেইল বিবিএস সার্ভিস প্রোভাইডাররা ইউইউসিপির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ডায়ালআপ সিস্টেমে স্থানান্তর করতো।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ট টেলিফোন বোর্ড দুইটি আইএসপি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। তখন দেশে প্রথম ইন্টারনেটের জন্য ভিস্যাট স্থাপন করা হয়। তখন প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের জন্য খরচ হতো ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অন্যান্য আইএসপিদের লাইসেন্স দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি বিটিআরসি নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সাবমেরিন কানেক্টিভিটিতে যুক্ত হয়।

জিপিআরএস টেকনোলজি দিয়ে ২০০৪ সালে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। ২০০৬ সালে জিপিআরএসের তুলনায় কিছুটা গতি সম্পন্ন এজ সার্ভিস চালু করে বেসরকারি টেলিকম অপারেটর গ্রামীনফোন। ২০০৮ সালে ওয়াইম্যাক্স সেবা পরিচালনার জন্য লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অজের প্রথম ওয়াইম্যাক্স সেবা কিউবি চালু করে ২২ নভেম্বর ২০০৯ এ।

এরপর ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর দেশের সরকারি টেলিকম অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থ্রিজিতে পদার্পন করে।

ফোরজি সেবায় বাংলাদেশ
সরকারের ঘোষণা মতে, ১৯ ফেব্রয়ারি ২০১৮-তে আরেকটি মাইলফলক অর্জন করছে বাংলাদেশ। এদিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে চালু হচ্ছে ফোরজি সেবা। এদিনই ফোরজি সেবার লাইসেন্স হস্তান্তর করা হবে এবং ওই দিনই সেবা শুরু হবে। এজন্য সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তরঙ্গ বিক্রির নিলামে আয় হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এই রাজস্ব নিঃসন্দেহে সরকারের জন্য একটি বড় আয়।

নীতিমালার বিধান অনুসারে ১৮ মাসের মধ্যে সবগুলো জেলা শহরে ফোরজির সেবা চালু করতে হবে অপারেটরদেরকে। আর ৩৬ মাসের মধ্যে দেশের উপজেলা পর্যায়ে এই সেবা নিয়ে যেতে হবে।

গ্রাহকসেবার মান
প্রায় সাড়ে ৫ বছর পরে এসেও দেশের থ্রিজির মান সম্পর্কে আমরা ভালোভাবেই অবগত। ঢাকাতেই অনেক জায়গায় এখনও থ্রিজি পাওয়া যায় না! আর অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থাতো করুণ। বলা চলে, ঢাকায় থ্রিজি আইসিইউ-তে আর ঢাকার বাইরে সেটা লাইফ সাপোর্টে।

অপারেটরগুলোর দাবি অনুযায়ী সারাদেশেই থ্রিজি কাভারেজ রয়েছে। তবে শহর ও উপজেলা পর্যায় থেকে একটু গ্রামে গেলে থ্রিজির দেখা পাওয়া ভাগ্যেরই বিষয়। এমনকি কখনও কখনও মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকলেও ইন্টারনেট পাওয়া যায় না।

থ্রিজির ক্ষেত্রে অপারেটররা গ্রাহক সেবার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে সক্ষমতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। ফোরজির ক্ষেত্রেও যদি এমনটি ঘটে তাহলে কতোটুকু লাভ হবে?

অবকাঠামোগত মান
বিভিন্ন সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে পৌনে দুই কোটি মোবাইল ব্যবহারকারীর হাতে থ্রিজি অ্যানাবল হ্যান্ডসেট রয়েছে। এই অল্প পরিমাণ হ্যান্ডসেট থাকা স্বত্বেও মোবাইল অপারেটরগুলো সঠিকভাবে থ্রিজি সেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে মাত্র মাত্র দেড় থেকে তিন বছরের মধ্যে সকল জেলা উপজেলার গ্রাহকের হাতে ফোরজি অ্যানাবল হ্যান্ডসেট পৌঁছে যাওয়ার আশা করাটা একটু বেশী মাত্রায় উচ্চাভিলাষী।

অপরদিকে অপারেটরগুলোর যে পরিমান স্পেকট্রাম রয়েছে তার তুলনায় গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেশি। ফোরজির নিলামে ওঠা স্পেকট্রামের তিন ভাগের একভাগও বিক্রি হয়নি। তাহলে এতো কম স্পেকট্রামে অপারেটরগুলো কীভাবে দেশব্যাপী গ্রাহকদের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে পারবে?

হাজার কোটি টাকার তরঙ্গ ফি এবং তারচেয়েও অধিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার বাবদ ইনভেস্টমেন্ট করার পর অপারেটরদের জন্য সেই ইনভেস্টমেন্ট রিটার্নের ব্যবসায়িক ক্যালকুলেশন করাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায়, অপারেটররা ডাটা প্যাকেজ বদলে ব্যান্ডউইথ প্যাকেজ অফার করবেন অথবা ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে ফেলবেন; এমনটা আশা করা কতোটা যৌক্তিক হতে পারে?

গ্রাহক সচেতনতা
দেশে ফোরজির প্রসারে অন্যতম চালিকাশক্তি গ্রাহক সচেতনতা। গ্রাহকরা যদি ফোরজি এবং আগের নেটওয়ার্কের মধ্যে পার্থক্য না বুঝতে পারে তাহলে তারা ফোরজি কতোটা গ্রহণ করবে সেটাই ভাবার বিষয়। অপারেটরগুলো ইতিমধ্যেই সিম বদলানোর ফি সাপেক্ষে গ্রাহকদের ফোরজি সিম দেয়া শুরু করেছে। কিন্তু না বুঝেই কেউ যদি ফোরজি সিম গ্রহণ করে তাহলে লাভটা কী? গ্রাহকদের ফোরজি হ্যান্ডসেট আছে কিনা সেটি দেখে নাকি না দেখেই সিম প্রদান করছে? এ বিষয়ে কোনও নির্দেশনা আছে বলে জানা যায়নি!

গতি মান নির্ধারণ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্রডব্যান্ড এবং ফোরজির সর্বনিম্ন গতি নির্ধারণ করা আছে। আমাদের দেশে বছর দুয়েক আগে ব্রডব্যান্ডের সর্বনিম্ন গতি ১ এমবিপিএস নির্ধারণ করা হলেও সেটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এখনও বিভিন্ন আইএসপি ৫১২ এমনকি ২৫৬ কেবিপিএসে ব্যবসা করছে।

বিশ্বে ফোরজি প্রযুক্তির গড় গতি ১৬ এমবিপিএস। ভারতে যা ৬ এমবিপিএস আর শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে ১০ থেকে ১৪ এমবিপিএসের মধ্যে। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বিটিআরসি কোন নিম্নসীমা নির্ধারণ করেছেন কিনা শোনা যায়নি এখনও।

ফলে সারাদেশে যথাযথ ফোরজি যথাসময়ে আমরা পাবো কিনা এবং এই প্রযুক্তি কিভাবে, কতোটা পরিমাণে আমাদের ইন্টারনেট গ্রাহকদের জন্য সুফল নিশ্চিত করবে সেটাই এখন প্রশ্ন।

ফোরজির সুফল পেতে করনীয় (প্রস্তাবনা)
১। স্বল্প সময়ে অধিকতর গ্রাহক সংখ্যা (ফোরজি অ্যানাবল হ্যান্ডসেট ব্যবহারকারী) বৃদ্ধির বিকল্প নাই। এই লক্ষে তাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন অতীব প্রয়োজন।

২। লোকাল কনটেন্টকে উৎসাহিত করার জন্য ভ্যাস গাইডলাইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপযুক্ত রেভিনিউ শেয়ারিং নিশ্চিত করতে হবে।

৩। ফোরজির জন্য প্রযোজ্য লোকাল কনটেন্ট তৈরিতে উৎসাহ বা প্রণোদনা প্রকল্প প্রণয়ন করতে হবে। (বিটিআরসির বিশাল কোষাগার এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে)

৪। দেশিয় উৎপাদন উৎসাহিত করে হ্যান্ডসেটের স্বল্পমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে হ্যান্ডসেট তৈরি শুরু হয়েছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোকেও বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে হ্যান্ডসেট তৈরিতে উৎসাহিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে।

৫। অপারেটরদের সেবার মান নিশ্চিতকল্পে দ্বিবার্ষিক সার্ভিস অডিট পরিচালনা এবং সেই অডিট রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অপারেটরগুলো তাদের মানোন্নয়নে দৃষ্টি দেবে।

৬। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট সকলের জবাবদিহিতা থাকতে হবে এবং জনসাধারণের ফোরজি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

লেখক : সিইও, চ্যাম্পস টোয়েন্টিওয়ান ডটকম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন