১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলাকালীন ২য় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৪ সালের জুন মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সংঘটিত হয় ব্যাটল অফ নরম্যান্ডি। এই যুদ্ধে জয়ের ফলেই পরবর্তীতে মিত্রবাহিনীরা জার্মান নাৎসিদের কবল থেকে ফ্রান্সকে উদ্ধার করতে সফল হয়।
অপারেশন ওভারলর্ড কোডনামের এই যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৪৪ সালের ৬ জুন যে দিবসটিকে ডি-ডে (D-Day) বলেও ডাকা হয়ে থাকে। সেই থেকে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় ধরণের সাফল্যমন্ডিত কোন দিনকে ইংরেজিতে ডি-ডে বলে অভিহিত করা হয়।
এই দিন আমেরিকান, ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান যৌথবাহিনীর প্রায় ১,৫৬,০০০ সৈন্য ফ্রান্সের নরম্যান্ডি অঞ্চলের উপকূলে ৫০ মাইল দীর্ঘ একটি সৈকতের উপরে ৫টি ভাগে ভাগ হয়ে অবতরণ করে। এটি ছিল ইতিহাসে পৃথিবীর সব চাইতে বড় উভচর আক্রমণগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর ডি-ডে এই বিশাল আক্রমণের অনেক আগে থেকেই জার্মান বাহিনীকে ভুল পথে চালনা করার বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করে মিত্রবাহিনী।
২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরপরই ১৯৪০ সালের মে মাসের মধ্যেই ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দখল করে নেয় হিটলারের নাৎসি বাহিনী। একই মাসে ব্যাটল অফ ফ্রান্সে ডানকির্কে জার্মানদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় ব্রিটিশ বাহিনী। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পক্ষে যোগ দেয়। তারপর ১৯৪৩ সাল থেকেই তারা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্স দখলকারী নাৎসি বাহিনীর উপর একটি বড়সড় আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করতে থাকে।
এরকম একটি আক্রমণের কথা আঁচ করতে পেরে ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে অ্যাডলফ হিটলার ফ্রান্সের উত্তর উপকূলের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য দায়িত্ব দেয় জার্মানির অন্যতম সেরা কমান্ডার ফিল্ডমার্শাল আরউইন রোমেলকে। যদিও জার্মানরা নিশ্চিত ছিলনা ঠিক কোন জায়গাটিতে আঘাত হতে পারে কিন্তু তারপরও প্রায় ২,৪০০ মাইল এলাকাজুড়ে উপকূল ও পানিতে মাইন, বাংকার, কাঁটাতার এসব দিয়ে এক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন রোমেল। নাৎসি বাহিনীর সবথেকে চৌকস সৈন্যগুলোকে নিয়োগ দেয়া হয় এখানে।
অন্যদিকে অপারেশন ওভারলর্ড পরিচালনার জন্য সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ডুয়েট আইজেনহাওয়ার ও ব্রিটেনের বার্নার্ড মন্টগোমারিকে। জার্মানরা ভেবেছিল ইংলিশ চ্যানেলের সবচেয়ে সরু জায়গাটি দিয়েই আক্রমণ করবে মিত্রবাহিনী। কিন্তু বিভিন্ন কৌশলে জার্মানদেরকে দ্বিধান্বিত করা হয়। যদিও আইজেনহাওয়ারের পরিকল্পনা ছিল ৫ জুন আক্রমণ করার কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে এই অপারেশন ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়।
৬ জুন, ১৯৪৪ সালে ৫ হাজার জাহাজ এবং ১৩ হাজার এয়ারক্রাফটের এক সম্মিলিত বাহিনী আক্রমণ করে নরম্যান্ডি উপকূলে। তার আগেই কয়েক হাজার প্যারাট্রুপার এবং গ্লাইডার ট্রুপার গোপনে নামানো হয় ঐ অঞ্চলের ব্রিজ এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর দখল নেয়ার জন্য। ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে সেই দিন মিত্রবাহিনীর ১,৫৬,০০০ এর বেশি সৈন্য নরম্যান্ডি উপকূলে নামতে সক্ষম হয়। কয়েকটি হিসেবমতে সেদিন মিত্রবাহিনীর ৪ হাজারের বেশি সৈনিক মারা পড়ে এবং অসংখ্য আহত ও নিখোঁজ হয়। অন্যদিকে নাৎসি বাহিনীর ৪ থেকে ৯ হাজার সৈন্য হতাহত হয়। সেদিনকার যুদ্ধে মিত্রবাহিনী জয়লাভ করে এবং নরম্যান্ডি উপকূল দখল করে নেয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় সোয়া ৩ লাখ সৈন্য, ৫০ হাজারের বেশি যুদ্ধযান এবং ১ লাখ টনের বেশি যুদ্ধ অস্ত্র এনে জড়ো করা হয় এই উপকূলে।
হিটলারের ধারণা ছিল এটি শুধুমাত্র জার্মান বাহিনীর মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর জন্য সীন নদীর আশপাশ দিয়ে ছোটখাটো একটা আক্রমণ করবে মিত্রবাহিনী। সেই সাথে বেশ কিছু ভুল তথ্য জার্মানদের দ্বিধান্বিত অবস্থায় ফেলে দেয় এবং সেনাপতি রোমেলের অনুপস্থিতির কারণেই পরাজয় হয় তাদের।
আগস্ট মাসের শেষের দিকেই ফ্রান্স পুনুরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় মিত্রবাহিনী এবং হয় দিয়ে ব্যাটল অফ নরম্যান্ডি শেষ করে তারা।
নরম্যান্ডি অবতরণ বা ডি-ডে কে বলা হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জয়ের সূচনা। এই সাফল্যের পরেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং অবস্থা নাৎসিদের প্রতিকূলে চলে যায়। হিটলারকে মানসিকভাবেও ভেঙে দেয় এই পরাজয়। ১৯৪৫ সালের ৮ মে আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় বরণ করে নেয় নাৎসি বাহিনী। এর আগে এপ্রিলের ৩০ তারিখ আত্মহত্যা করে নাৎসি বাহিনীর প্রধান অ্যাডলফ হিটলার।
ডি-ডে নিয়ে প্রচুর সিনেমা এবং তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু বিখ্যাত সিনেমা হচ্ছে Saving Private Ryan (1998), The Longest Day (1962), Where Eagles Dare (1968), The True Glory (1945), D-Day The sixth of June (1956) ইত্যাদি। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে স্টিভেন স্পিলবার্গের পরিচালিত সেভিং প্রাইভেট রায়ান সিনেমাটি। এই সিনেমার শুরুর ২৭ মিনিটে ডি-ডে যুদ্ধকে অত্যন্ত বাস্তবভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।