কোভিড ১৯-এর জিনতত্ত্ব ও বিবর্তন

প্রকাশের তারিখ:

প্রকৃতিতে এখনও পর্যন্ত মানুষের জানা দু’শোরও বেশি এই ধরনের করোনাভাইরাস রয়েছে। যার মধ্যে অবশ্য মাত্র সাতটি করোনাভাইরাসই মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। যার সপ্তমটি হল কোভিড ১৯। লিখছেন অভিষেক জয়সওয়াল

করোনাভাইরাসেস। সহজ ভাষায় বলতে হলে এক বিশেষ ধরনের ভাইরাসের পরিবার। প্রকৃতিতে এখনও পর্যন্ত মানুষের জানা দু’শোরও বেশি এই ধরনের করোনাভাইরাস রয়েছে। যার মধ্যে অবশ্য মাত্র সাতটি করোনাভাইরাসই মানুষের শরীরে সংক্রমণ করতে সক্ষম। সপ্তমটি হল বর্তমানে বিশ্বময় ত্রাসের কারণ। নাম সার্স-কোভ-২ বা ‘কোভিড ১৯’।

করোনাভাইরাসেস-এর যে সাতটি মানব শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম, তার মধ্যে চারটি ভাইরাস, যথা, ‘এইচকিউওয়ান’, ‘এনএল৬৩’, ‘ওসি৪৩’ এবং ‘২২৯ই’ ভাইরাসকে আপাত ভাবে নিরীহ বলা যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের সাধারণ সর্দি-কাশির কারণ এই চারটি। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাইরাসগুলি হল যথাক্রমে ‘সার্স-কোভ’ ও ‘মার্স-কোভ’। এই দুই ভাইরাস মানবদেহে শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ তৈরি করে। এর পরে আসে ২০১৯ সালে আবিষ্কৃত ভাইরাস সার্স-কোভ-২। এই পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ভাইরাসগুলি মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে।

কিন্তু সার্স-কোভ-২ বা ‘কোভিড ১৯’ কেন হঠাৎ প্যানডেমিক আকার নিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরের বেশির ভাগটাই এখনও আমাদের অজানা। কোভিড ১৯ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, ‘কোভিড ১৯’-এর জিনগত বিন্যাস, গঠন এবং কর্মপদ্ধতি। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যেও এখনও বহু শূন্যস্থান রয়ে গিয়েছে। তবে যতটুকু জানা গিয়েছে, তার খানিকটা এখানে সহজ ভাবে বলার চেষ্টা করলাম।

আমরা মোটামুটি সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই জেনেছি, জীবকোষে দু’ধরনের নিউক্লিক অ্যাসিড থাকে। একতন্ত্রী রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড অর্থাৎ, আরএনএ এবং দ্বি-তন্ত্রী ডি-অক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড অর্থাৎ, ডিএনএ। জীবকোষের যাবতীয় কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে এই ডিএনএ এবং আরএনএ। যে সমস্ত কোষ ডিএনএ নিয়ন্ত্রিত, সেখানে ডিএনএ-এর সজ্জাবিন্যাসকে (টেমপ্লেট) বুঝে এম-আরএনএ (mRNA) এবং টি-আরএনএ (tRNA) কোষের অঙ্গাণু রাইবোজোমের সহায়তায় নানা প্রোটিন (নানা ধরনের উৎসেচকও হতে পারে) তৈরি করে। এই উৎসেচকগুলি কোষ তথা মানবদেহের বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করে।

‘কোভিড ১৯’ ভাইরাসটি ‘বিটা কোরোনাভাইরাস’ পরিবারের ‘সার্বেকো ভাইরাস সাব জেনাস’-এর সদস্য। এটি এক ধরনের পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস। আরএনএ ভাইরাস হতে পারে দু’রকম। ‘পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস’ ও ‘নেগেটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস’। পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস ‘হোস্ট’-এর কোষে ঢুকে নিজেই নিজেকে এমআরএনএ (mRNA) হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। হোস্ট কোষের জেনেটিক ম্যাটিরিয়ালের সাহায্য লাগে না। নেগেটিভ সেন্স ভাইরাসেরা অবশ্য তা পারে না। তাদের আরএনএ জটিল প্রক্রিয়ায় নিজের জিনোমের পজিটিভ সেন্স প্রতিলিপি তৈরি করে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে।

‘কোভিড ১৯’ এক ধরনের পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস হওয়ায় এঁরা আক্রান্তের (‘হোস্ট’, এ ক্ষেত্রে মানুষ) শরীরের কোষে ঢুকে সরাসরি নিজেকে ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজনীয় এনজ়াইম তৈরি করে নিতে পারে। যে এনজ়াইম বা উৎসেচকের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল রেপ্লিকেস ১এবি বা ১এবি পলিপ্রোটিন। এটি বহুক্রিয়া সম্পন্ন একটি প্রোটিন যা এই ভাইরাসটির নিজস্ব এমআরএনএ গঠন এবং জিনোমের প্রতিলিপি গঠন অর্থাৎ, রেপ্লিকেশনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে, খুব সহজেই আক্রান্তের কোষে দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে পারে এই ভাইরাস।

১এবি পলিপ্রোটিন ছাড়াও এই ভাইরাস আরও চারটি কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল) প্রোটিন তৈরি করে: ‘S’ (স্পাইক), ‘E’ (এনভেলপ), ‘M’ (মেমব্রেন) এবং ‘N’ (নিওক্লিওক্যাপসিড) প্রোটিন। এখানে ‘N’-প্রোটিনটি ভাইরাসের আরএনএ জিনোমকে একত্রে ধরে রাখে খোলকের মধ্যে। S, E, M প্রোটিন ভাইরাসের বাহ্যিক আকার আকৃতি গঠনের উপাদান হিসেবে কাজ করে।

এখানে S বা স্পাইক প্রোটিনটি কোভিড ১৯-এর কার্যপ্রক্রিয়া বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রোটিনটি থাকে কোভিড ১৯-এর মেমব্রেনে। S বা স্পাইক প্রোটিনের একটি বিশেষ অংশ (রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন) হুকের মতো মানবকোষের পর্দায় থাকা ‘রিসেপ্টর’-এর সঙ্গে আটকে যায়। এই S বা স্পাইক প্রোটিনেরই আরেকটি অংশ (ক্লিভেজ সাইট) ওই আটকে যাওয়া জায়গায় মানবকোষের পর্দায় ছিদ্র তৈরি করে। তারপর সেখান থেকেই একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় গোটা ভাইরাসটিই মানবকোষের ভিতরে ঢুকে যায়। এই ছিদ্র তৈরি করার ক্ষেত্রে এই ভাইরাস এক অনন্য পদ্ধতি (‘পলি বেসিক ক্লিভেজ’) অবলম্বন করে। সেই কারণে একে ‘নোভেল করোনাভাইরাস’
বলা হয়।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিন মানবকোষের বিশেষ কিছু রিসেপ্টরকে কোষে ঢোকার জন্য ব্যবহার করে। যার মধ্যে একটি হল, অ্যাঞ্জিয়টেন্সিন কনভার্টিং এনজাইম (এসিই ২) নামক একটি প্রোটিন। হৃদরোগী, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস জনিত কারণে যাঁরা ভোগেন, তাঁরা সাধারণত এই ধরনের (অ্যাঞ্জিয়টেন্সিন কনভার্টিং এনজাইম এসিই ২) রিসেপ্টর প্রোটিনের জন্য ওষুধ খেয়ে থাকেন। এই ওষধুগুলি খাওয়ার ফলে তাঁদের শরীরে এই ধরনের রিসেপ্টরের সংখ্যা বেড়ে যায়। যার ফলে, এঁদের কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে কয়েক গুণ। সেই কারণেই বার বার এই ধরনের রোগীদের অত্যন্ত সাবধানে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে প্রশাসনের তরফে।

কোভিড ১৯-এর প্রভাব কেন এত মারাত্মক, আর কেনই বা তার এত দ্রুত বিস্তার? এর উত্তর হিসেবে বিজ্ঞানীরা বেছে নিয়েছেন বিবর্তন (ইভোলিউশন) এবং পরিব্যক্তি (মিউটেশন)-এর তত্ত্বকে। বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাস সম্পর্কে দু’টি কার্যকর অভিমত দিয়েছেন। প্রথমত, মানুষের মধ্যে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার আগেই একটি প্রাণী ‘হোস্ট’-এর মধ্যে তার প্রাকৃতিক নির্বাচন (ন্যাচরাল সিলেকশন) পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। দ্বিতীয়ত, কোনও প্রাণী ‘হোস্ট’ থেকে এই ভাইরাসটি যখন প্রথম কোনও মানুষকে সংক্রমিত করেছিল তখনও সেখানে তার প্রাকৃতিক নির্বাচন (ন্যাচরাল সিলেকশন) ঘটেছিল। যার ফলশ্রুতি এই প্রাণী থেকে মানুষে ‘হোস্ট’ পরিবর্তন।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ৮৬টি সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সম্পূর্ণ বা নিকটতম সম্পূর্ণ জিনোম বেছে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন। দেখা গিয়েছে, সার্স-কোভ-২ এর পুরো জিনোমে ৯৩টি ‘মিউটেশন সাইট’ রয়েছে। ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরাও ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং নেপালের সংক্রমণকারী ভাইরাসের সঙ্গে চিনের উহান কোভিড ১৯-এর জিনোমের তুলনা করে দেখেছেন। দেখা গিয়েছে, নেপাল ছাড়া প্রত্যেকটি সার্স-কোভ-২ এর জিনোমে মিউটেশন ঘটেছে। যেগুলি এই ভাইরাসের সংক্রমণ করার ক্ষমতাকে সহস্রাধিক গুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। সুতরাং, বোঝা যায়, এই ভাইরাস নিজেকে দ্রুত বিকশিত করতে কতটা সক্ষম এবং এর মিউটেশনের ধরন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন। এই মিউটেশন অনুযায়ী, এর প্রকোপ এক দেশের থেকে অন্য দেশে আলাদা।

এ বার তাহলে একটি জনপ্রিয় প্রশ্নে আশা যাক। ভাইরাসটি মনুষ্য সৃষ্ট নাকি প্রাকৃতিক! সম্প্রতি ‘নেচার মেডিসিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিসার্চ পর্যালোচনায় দাবি করা হয়েছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি পুরোপুরি প্রাকৃতিক। বিজ্ঞানীরা এখানে দু’টি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। প্রথমত, স্পাইক প্রোটিনের ‘রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন’ (আরবিডি) এবং দ্বিতীয়ত, ‘ক্লিভেজ সাইট’-এর উপর। তাঁদের মতে, স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশের মিউটেশন এবং এর সম্পূর্ণ ভিন্ন কাঠামোগত মেরুদণ্ড, এই ভাইরাসের মনুষ্য সৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভাবে খারিজ করে।

যাইহোক, সার্স-কোভ-২ জিনোমের এখনও অনেক রহস্য উন্মোচিত হওয়া বাকি। আশা রাখি, ভবিষ্যতে এই তথ্যগুলি এই ভাইরাসটি বা এইরূপ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করবে। উল্লেখ্য যে ‘প্রতিরোধ সর্বদা রোগ নিরাময়ের চেয়ে ভাল’। তাই বারবার হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন এবং বাড়িতে থাকুন।

লেখক : বিজ্ঞানী, ডিপার্টমেন্ট অফ হেল্‌থ রিসার্চ, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক
সূত্র : আনন্দবাজার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন

শেয়ার করুন:

সাবস্ক্রাইব

জনপ্রিয়

এ সম্পর্কিত আরও কিছু পোস্ট
Related

ভুলে আবিষ্কার হয়েছিল এক্স-রে!

ঊনবিংশ শতাব্দীর এক পদার্থবিদ, যিনি পরীক্ষাগারে সামান্য ভুল থেকে...

দেশের বাজারে রেডমি নোট ৯ সিরিজের নতুন তিন স্মার্টফোন

গ্লোবাল টেকনোলজি লিডার শাওমি বাংলাদেশের বাজারে নোট সিরিজের তিনটি...

বাংলাদেশে রিয়েলমির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

স্মার্টফোন ব্র্যান্ড রিয়েলমি বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। গত...

আরঅ্যান্ডডি খাতে ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে অপো

স্মার্ট ডিভাইস ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে আগামী...