মানসা মুসা: ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি

আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি কে? তাহলে অবশ্যই বলবেন বিল গেটস কিংবা ওয়ারেন বাফেটের কথা। কিন্তু আমরা অনেকেই ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির নাম জানি না। আসুন জেনে নিই বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মানসা মুসা সম্পর্কে।

মানসা মুসা, চৌদ্দ শতকের মালির মুসলিম শাসক। মানসা শব্দের অর্থ সুলতান, বিজেতা বা সম্র্রাট। মানসা ছিলেন মালি সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সান্দিয়াতা কেইতা’র ভাগ্নে। ১৩১২ সালে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি প্রথম আফ্রিকান শাসক যিনি ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনিই বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তি।

অর্থবিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ইতিহাসে আলোচিত মানসা মুসা। তার সম্পদের পরিমান এত ছিল যে সঠিক হিসাব করা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, তার সেই সময়ের সম্পত্তির বর্তমান মূল্য প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রথসচাইল্ড ফ্যামিলি, বিল গেটস কিংবা ওয়ারেন বাফেটের সম্পদের চেয়ে ঢের বেশি।

২০১৫ সালে প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী টাইম বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ১০ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে মানসা মুসার নামটি ছিল সবার প্রথমে।

Mansa Musa- King of Mali
ছবি : সংগৃহীত

১২৮০ সালে জন্মগ্রহণ করা মানসা মুসা মাত্র ৩২ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৩১২ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তিনি দ্বিতীয় আবু বকর কেইতার উত্তরসূরী। আবু বকর আটলান্টিক মহাসাগরের সীমানা অনুসন্ধানের জন্য পাড়ি জমান। যাত্রার আগেই মুসাকে তার মনোনীত করে যান। কিন্তু দীর্ঘদিন পর ফিরে না আসায় মালির সম্রাট হিসেবে মুসা পুরোপুরিভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

মুসা এমন সময় দায়িত্ব পান যখন ইউরোপীয় জাতি যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকা ও সম্পদের অভাবে ভুগছিলো। কিন্তু মুসার সময়েই প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন সোনা ও লবনে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠে এই জনপদ। তার রাজত্বের পরিধিও বাড়তে থাকে। এছাড়া সুবিশাল সাম্রাজ্য থেকে রাজস্বের মাধ্যমে মুসা সম্পদশালী হতে থাকে।

Mansa Musa on His Way to Mecca, c1670, (1903)
মানসা মুসার হজ যাত্রা। ছবি : সংগৃহীত

তবে, ১৩২৪ সালের আগে মালির বাইরের কেউ মুসা সম্পদের চমক দেখেনি। সেই বছর তিনি প্রায় চার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে মক্কায় হজ করতে যান। ধারণা করা হয়, পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম শাসকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম হজ পালনের জন্য মক্কা যান। তবে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল অন্যখানে। এই যাত্রায় তার সাথে ছিল প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ছিল সৈন্য ও দাস-দাসী। সাথে ছিল মুসার স্ত্রী ইনারি কোঁতে, যার সেবায় ছিল ৫০০ দাসী।

দাসদের প্রত্যেকের কাছে ছিল ৪ পাউন্ডের সোনার বার। সাথে থাকা ৮০টি উটের পিঠে ৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ড করে সোনা ছিল। তার এই যাত্রাপথে তিনি প্রায় কয়েকশত কোটি টাকা মূল্যের সোনা বিতরণ করেছিলেন। কায়রোতে তিনি এত বেশি স্বর্ণ বিতরণ করেছিলেন যে, বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে স্বর্ণের দাম তুলনামুলকভাবে অনেক কম ছিল।

শুধু দান করাই নয়, যাত্রাপথে তিনি অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন। শোনা যায়, প্রতি শুক্রবারে একটি করে মসজিদ নির্মাণ করতেন। গরিবদের পাশাপাশি শহরগুলোর শাসকদেরকেও প্রচুর স্বর্ণ উপহার দেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিভিন্ন স্যুভেনিয়ার কেনেন। এর ফলে মিসরের স্বর্ণের বাজারে বিশাল মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। ফেরার পথে মুসা মিসরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে স্বর্ণ ধার নেন। কিন্তু তারপরেও মিসরের স্বর্ণের বাজার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় এক দশক সময় লাগে।

Mansa Musa, King of Mali
ছবি : সংগৃহীত

ইসলাম প্রচার, মসজিদ নির্মান, দান ইত্যাদির পাশাপাশি তিনি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠা করেন তিম্বাকতু বিশ্ববিদ্যালয়, সানকোর বিশ্ববিদ্যালয়।

২৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৩৩৭ সালে মুসা মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে তার সম্পদ ধ্বংস, লুট হয়ে যায়। তবে তিনি ইতিহাসের পাতায় এখনও সমুজ্জ্বল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী হিসেবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন