শিশুদের সাথে কেন ইন্টারনেট নিয়ে কথা বলা উচিত?

আজকের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠছে। প্রযুক্তির কুফল থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য ইন্টারনেটকে বোঝার ক্ষেত্র থেকে আমাদেরকে একধাপ এগিয়ে থাকতে হবে। নিজেদেরকে সচেতন করার মাধ্যমে আমরা আমাদের সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের কুফল ও এর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারি।

বাস্তব জীবনের সাথে অনলাইন জগতের ভারসাম্য আনা
ঘর/ বাহিরের কর্মকান্ড, বাস্তব/ভার্চুয়াল জগতের মেলামেশা, বাস্তব/ভার্চুয়াল জগতের শিক্ষা, গেইম খেলা, কম্পিউটারে চ্যাট করা, বন্ধুদের মেসেজ পাঠানো… এসব কিছুই এখন প্রায় সবার জন্য রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল শিশুরা খুব অল্প বয়স থেকেই এসব ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক একটি ভারসাম্য তৈরি করা, যাতে তাদের সন্তান বাস্তব জীবনের বিভিন্ন কর্মকান্ডেও যথেষ্ট সময় ব্যয় করে- যেমন, বন্ধুদের সাথে খেলা বা বাইরে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। অভিভাবকদের প্রধান কাজটি হলো ডিজিটাল জগত ও বাস্তব জীবনের মাঝে সঠিক এক সমন্বয় সৃষ্টি করা।

আমাদের পরামর্শ : একটি সঠিক দৈনন্দিন রুটিনের গুরুত্ব সম্পর্কে শিশু ও শিক্ষার্থীদের সাথে খোলামেলা আলাপ করুন। তাদের দিনের কাজগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দিন। যেমন: ১) স্কুল ও হোমওয়ার্কের জন্য একটি সময়, ২) অনলাইনে গেইম খেলা ও বিনোদনের জন্য একটি সময়, ৩) বাসার বাহিরে গিয়ে খেলার জন্য একটি সময় এবং ৪) পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটানোর জন্য একটি সময়। [সূত্র – সেইফ ইন্টারনেট ডটঅর্গ]

বাস্তবতা : একবার যদি অনলাইনে কোন কিছু পোস্ট করা হয়, সেটা আর অনলাইন থেকে ডিলিট করা সম্ভব না।

অনেকের কাছে যদিও মনে হতে পারে যে, আমরা অনলাইন পোস্টগুলো যে কোন সময় ডিলিট করতে পারি, আসলে সেটা সম্ভব হয় না। একবার কোন কিছু অনলাইনে পোস্ট হয়ে গেলে সেটা সবসময় অনলাইনে থেকে যায়- এখানে ‘ডিলিট’ বা ‘আনডু’ করার কোনো সুযোগ নেই। অনলাইনে পোস্ট করা কোন লেখা বা ছবি আমাদের নিজেদের বা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে, কারণ এগুলো মুহূর্তেই অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। ছবি বা লেখাগুলোর অপব্যবহার হতে পারে অথবা এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কোন নেটওয়ার্কে শেয়ার করা হতে পারে, যা সবার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই, চিন্তাভাবনা করে অনলাইনে কোনকিছু পোস্ট করতে হয়। অনেক সময় গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশু এবং কিশোরদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা অপরিচিত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগের বিষয়ে সচেতন নয়।

অপরিচিত লোকজন থেকে সাবধান থাকা
সোশ্যাল মিডিয়ার মত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অপরিচিত লোকজনের সাথে যোগাযোগ করা যে কোন শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু অনলাইনে কারো পরিচয় সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না, সে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার জন্য অভিভাবক ও শিশুদের সচেতন হওয়া দরকার।

সাইবার বুলিং
অনেকের কাছে অনলাইনে যেটা নিরাপদ মনে হয়, অন্যের জন্য তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইন্টারনেটে অন্যদের সাথে আমরা কিভাবে কথা বলব এবং সেখানে কিভাবে আমরা অপরিচিত বা অন্যদের সাথে যোগাযোগ করব তা সবার অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত। আর এভাবে আমরা অনলাইনে গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য আচরণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি।

মালয়েশিয়ায় ২০১৪ সালে পরিচালিত একটি জরিপে জানা গেছে, সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিশুদের অর্ধেকই অভিভাবকদের নজরদারি ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহার করে, যা আগামীতে এশিয়ার বাকি দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। এই জরিপে দেখা যাচ্ছে যে সেখানে বর্তমানে প্রতি চারজন স্কুল শিক্ষার্থীর একজন জানাচ্ছে, তাদের অনলাইনে ভয় দেখানো হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৫ বছরের শিশুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অনলাইনে উত্যক্ত করা ঘটনাও অনেক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতি চারজন শিশুর মাঝে তিনজনেরই এই অভিজ্ঞতা রয়েছে। উক্ত জরিপে অনলাইনে উত্যক্ত করার ঘটনাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে শিশুদের গালি দেয়া, অশোভন বার্তা ও ছবি পোস্ট করা ইত্যাদি হিসেবে। এখানে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে জরিপে অংশ নেয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিশু মনে করে অশোভন এসএমএস পাঠানো, ছবি পোস্ট করা বা অনলাইনে অন্যের পরিচয় বহন করা খারাপ কিছু নয়। অনলাইনে যারা অন্যদের ভয় দেখায় (সাইবার বুলিং) তারা নিজেরাই অনেক সময় নিজেদের কাজের পরিণাম সম্পর্কে জানে নাম, অথবা তারা যা করছে তাকে সাইবার বুলিং মনে করে না।

ব্রিটেন এবং আমেরিকাতে শিশুদের উত্যক্ত করার প্রভাব সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা পেতে পারি। ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি ব্রিটিশ টিনএজারদের উপর চালানো জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ১৩-২২ বছরের টিনএজারদের প্রতি দশজনের মধ্যে সাত জনকেই অনলাইনে উত্যক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রতি পাঁচ জনে একজন তাদের ঘটনাগুলোকে চরম বলে উল্লেখ করেছে। ২০১৪ সালে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি তরুণের উপর চালানো জরিপে বলা হয় যে, শতকরা ৫৪ জন তরুণ জানিয়েছে যে ফেইসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের সাইবার বুলিং এর অভিজ্ঞতা হয়েছে।

তবে এর পরিবর্তনও সম্ভব। ২০১১ সালে আমেরিকাতে হার্ভার্ড স্কুল অব হেলথ স্ট্যাডি দেখিয়েছে, যে স্কুলগুলোতে এন্টি বুলিং প্রোগ্রাম করানো হয়েছে, সেখানে এর পরিমান অর্ধেক কমে গেছে। নরওয়েতে এ নিয়ে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। ২০০৯ সালে টেলিনর এবং এর সহযোগীরা সাইবার বুলিং এর বিরুদ্ধে এক জাতীয় কর্মসূচি চালু করে। এই কর্মসূচি শত শত স্কুলের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে পৌছে যায়, যা শিশু, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের জানায় কিভাবে সাইবার বুলিং প্রতিরোধ করতে হবে। এর ফলাফল? কর্মসূচিতে অংশ নেয়া প্রতি চারজন শিশু কিশোরের তিনজন জানাচ্ছে যে তারা এখন জানে কিভাবে মোবাইল ও ইন্টারনেটে সাইবার বুলিং এড়িয়ে যেতে হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন