১৯৭৩ সাল। হল্যান্ডের জানফোর্তে চলছিল ফরমুলা ওয়ানের ডাচ গ্র্যান্ড প্রিক্স। দুর্দান্ত গতিতে একের পর এক ল্যাপ পার করছিলেন ব্রিটিশ ড্রাইভার রজার উইলিয়ামসন। সে বছরই ফরমুলা ওয়ানে অভিষেক হয়েছিল তার, অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
একে একে সাতটি ল্যাপ পার হয়ে আট নম্বর ল্যাপে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি। উইলিয়ামসনের গাড়ির চাকা ফসকে ট্র্যাকের ব্যারিয়ারে আঘাত করলো, উল্টে গেলো গাড়ি। মুহূর্তে দাউদাউ করে আগুন ধরে গেলো।
কাছাকাছিই ছিলেন দুজন আগুন নিভানোর কাজে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মী।ছুটে এলেন তারা, রেস ছেড়ে আরও ছুটে এলেন উইলিয়ামসনের বন্ধু ডেভিড পার্লি। কিন্তু বাঁচানো গেলো না হতভাগা রেসারকে। আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সী উইলিয়ামসন।
ফরমুলা ওয়ানের এখনকার ভক্তদের কাছে আগুন লাগার এই দৃশ্য তেমন পরিচিত নয়। যদি লাগে সাধের গাড়িটি পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কিন্তু হাসিমুখে ধোঁয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন রেসার। হেলমেট খুলে বিজয়ীর হাসি হাসেন, দর্শকদের দিকে হাত নাড়েন।
এটি সম্ভব হয়েছে যে চমৎকার প্রযুক্তির জন্য, তার নাম নোমেক্স (Nomex)।
এলো নোমেক্স
ফর্মুলা ওয়ানের শুরুর দিকে, অর্থাৎ ষাটের দশকে পেশাদার রেসারদের অবস্থান ছিল হলিউডের নায়কদের কাছাকাছি। তারা পোলো শার্ট আর রঙ-বেরঙের ট্রাউজার পরে রেসে নামতেন। নিরাপত্তার চেয়ে গ্ল্যামার আর আরামটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
রজার উইলিয়ামসন, নিকিলডা’র মতো আরও কিছু দুর্ঘটনার পর টনক নড়লো এফআইএ’র। এফআইএ হলো ইন্টারন্যাশনাল অটোমোবাইল ফেডারেশন, ফর্মুলা ওয়ানের চাবিকাঠি যাদের হাতে।সত্তর দশকের শেষ দিকে আগুন নিরোধক, অর্থাৎ ফায়ারপ্রুফ রেসিং স্যুট নিয়ে জোর গবেষণা শুরু হলো। নাসা তখন অহরহ মহাকাশে মানুষ পাঠাচ্ছে। নাসার কাছ থেকে নভোচারীদের স্পেস স্যুটের প্রযুক্তি ধার করে বানানো হলো দুই ধরনের রেসিং স্যুট—প্রোবান ও নোমেক্স।
নোমেক্স তুলনামূলক বেশি টেকসই, আগুনকে প্রতিরোধ করার সহজাত ক্ষমতা আছে। তাই এটি টিকে গেলো বাজারে। প্রায় ৪০ বছর পর এখনও রেসিং স্যুটের মূল উপাদান নোমেক্স। তবে নোমেক্স এর আগে আগুন প্রতিরোধে এসবেস্টসের ( Asbestos ) তৈরি পোশাক ব্যবহার করা হত। কিন্তু এই পোশাকের সমস্যা হচ্ছে পোশাকের ভিতরে উপস্থিত সিলিকেট উপাদান সমূহ। সিলিকেট উপাদানের কারণে ফুসফুসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটে। তাই, এসবেস্টসের তৈরি পোশাক বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি।
এটি আসলে নাইলনের মতো এক ধরনের সিনথেটিক পলিমার, তবে অনেক বেশি সহনশীল ও ঘাতসহ। ৮৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রায় ৩৫ সেকেন্ড পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে নোমেক্স। কোনো গাড়ি বা বাড়িতে আগুন লাগলে সাধারণত তাপমাত্রা ৬৫০ থেকে ৭৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
স্যুটের ভেতর
এখন রেসাররা যে স্যুট পরেন তাতে নোমেক্সের দুটি থেকে চারটি স্তর থাকে। রেসে ব্যবহারের আগে প্রতিটি স্যুটকে অন্তত ১৫ বার ধোয়া হয় ও ১৫ বার ড্রাই ক্লিন করা হয়। এরপর ৬০০ থেকে ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পরীক্ষা করা হয়। একটি স্যুট যদি আগুনের মধ্যে অন্তত ১১ সেকেন্ড ধরে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে, তাহলে সেটিকে ব্যবহারের উপযোগী ধরে নেওয়া হয়।
ফায়ার স্যুটের জিপার থেকে শুরু করে সুতা পর্যন্ত এই নোমেক্স দিয়ে তৈরি। আগুনের মধ্যে এই জিপার গলে যায় না বা উত্তপ্ত হয় না। সুতা তো পুড়েই না, সুতার ফাঁক গলে তাপ ঢুকতে পারে না।
কিন্তু স্যুটই কি সব ? শরীরের যেসব অংশ স্যুটের বাইরে থাকে ?
এক্ষেত্রেও নোমেক্সই ভরসা। রেসারদের গ্লাভ্স সরু নোমেক্স তন্তু দিয়ে তৈরি করা হয় যাতে স্টিয়ারিং ধরতে সুবিধা হয়। একইভাবে আগুন নিরোধক মোজা থেকে শুরু করে বুট, বুটের তলা পর্যন্ত। আর স্যুটের নিচে পরতে হয় ফায়ার প্রুভ আন্ডারওয়্যার ও হেলমেটের নিচে ব্যালাক্লাভা মাস্ক।
কৃতিত্ব যাদের
বাণিজ্যিক নাম ছাড়াও নোমেক্সের একটি রাসায়নিক নাম আছে—সিনথেটিক অ্যারোমেটিক পলিঅ্যামাইড পলিমার। বিখ্যাত রসায়ন ল্যাবরেটরি ডুপন্টের বিজ্ঞানী ড. উইলফ্রেড সুইনি এটি প্রথম তৈরি করেছিলেন। এখনও সারা বিশ্বে একমাত্র ডুপন্ট ল্যাবেই নোমেক্স তন্তু তৈরি করা হয়। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কাছ থেকে নোমেক্স নিয়ে স্যুট তৈরি করে।
ফরমুলা ওয়ানে নোমেক্স স্যুটের অবদান কতোটুকু তা বোঝার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। ১৯৯৪ সালের পর থেকে গত বিশ বছরে ফরমুলা ওয়ান রেসে কোনো রেসারের মৃত্যু হয়নি।