ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-
বীর প্রতীক এ কে এম জয়নুল আবেদীন খান জন্মগ্রহন করেন ১৯৫১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঝালকাঠি জেলার ধারাখানা গ্রামে। তার বাবার নাম মরহুম ছুমেদ আলী খান এবং মায়ের নাম মরহুমা বেগম চাঁন। মেধাবী ছাত্র জয়নাল আবেদীন খান ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে মেট্রিক এবং ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইন্ডিয়ার কাঠালিয়া ওম্পিনগর ও মতিনগর থেকে ট্রেনিং নিয়ে তিনি ২নং সেক্টরের অধীনে ঢাকা অঞ্চলে যুদ্ধ করেন। তিনি ঢাকায় গেরিলা দলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দলের কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার সাথে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালে তদানীন্তন বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে ।
……………………………………..
১৯৭১ সালের জুলাই মাস । ইন্ডিয়া যেতে হবে নতুন করে অস্ত্র আনতে। কারণ ইন্ডিয়া থেকে আমাদের যা অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়েছিল তা মোটামুটি সব খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যাবার আগে একটা উল্লেখযোগ্য অপারেশন করা দরকার। তা না হলে সেখানে গিয়ে সুপিরিয়র কমান্ডারদেরকে কি জবাব দেব? তারা আমাদের কাছ থেকে একটু বেশিই আশা করেন। কারণ সে সময় ইউনিভার্সিটির ছাত্র খুব কম।
এরই মাঝে আড়িখোলা পূবাইল রেল স্টেশনের একটা ট্রেন আসার সংবাদ পেলাম। যেটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ও অস্ত্র নিয়ে আসবে। সিদ্ধান্ত নিলাম সেই লাইনেই আমরা ট্রেন অপারেশন করবো। সেকেন্ড ইন কমান্ড জহিরের এক আত্মীয় রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। তিনি জহিরকে জানালেন ‘জহির তোমরা যদি তাদের রেলের কয়েকটা ইঞ্জিন পঙ্গু করে দিতে পারো তাহলে তাদের রেলওয়ে নেটওর্য়াকটা নষ্ট হয়ে যাবে’। তিনিই আমাদের বিস্তারিত তথ্যগুলো দিলেন।
ভোর ৬ টায় আড়িখোলা থেকে একটা মালবাহী ট্রেন আসে। সেই সাথে ওই ট্রেনে কিছু লোক নিয়েও আসে। যাদের মধ্যে আর্মিরাও থাকে । আমরা টার্গেট করলাম যে এই ট্রেনটাকে আক্রমণ করবো। ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই আমরা ১১ জন বালু নদী দিয়ে তলনা গ্রাম থেকে নাগরী নলছাটা (এই জায়গাটা বিখ্যাত কারণ সেখানে খ্রিষ্টানদের জন্য বিভিন্ন চার্চ আছে) গেলাম। আমরা সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ৮/৯ টা বেজে গিয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র , পি.কে (প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ) নিয়ে নৌকায় গিয়েছি। কিন্তু চিন্তার বিষয় যে অপারেশনটা কোন জায়গায় করবো। আমাদের ৪ টা বগি ক্যাপচার করার পরিকল্পনা।
স্লিপারের নিচে পাথর উঠিয়ে ৪০০-৬০০ গ্রাম করে পি.কে দিয়েছি। যে তারটা আমরা সংযুক্ত করবো সেটা হলুদ রংয়ের কর্ডেক্স । কর্ডেক্সকে একটার সাথে একটা কানেকশন করে সেটাকে প্রস্তুত করলাম। সার্কিট করার পরে রাত প্রায় ২/৩টা বাজলো। এর আগে জায়গা নির্বাচনে আমরা স্থানীয় লোকদের সাহায্য নিলাম। সেখানকার স্থানীয় মানুষ অধিকাংশ জেলে এবং হিন্দু। তাদের বাড়ি গিয়ে উঠলাম। তারা প্রথম ভয় পেয়ে গিয়েছে আমাদের দেখে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করে বললাম ‘ আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের একটু জায়গা দাও। আমরা ট্রেন আপারেশন করবো’।
কিন্তু তারা তো জানে যে জায়গায় অপারেশন হয় সেসব জায়গার আসে পাশের ১/২ মাইল এলাকা আর্মিরা জ্বালিয়ে দেয়। তাই তারা সহজে রাজি হয় না। তাই তাদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে আমি একটা রাজনৈতিক ভাষণ দিলাম যে মুক্তিযুদ্ধ কেন? যুদ্ধ করলে কি হবে ? আজকে তোমরা কি অবস্থায় আছো? সেখানে বসে ঘরোয়াভাবে প্রায় ১ ঘন্টা তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করলাম। এরপর প্রতিটি পুরুষ মহিলা ছেলে মেয়ে রাজি হয়ে জানালো যে হ্যাঁ আমরা জায়গা দেব তবে এখানে না, অন্যখানে নিয়ে যাবো । তারা এমন একটা খালি জায়গা দিল যেখানে আসে পাশে গ্রাম নেই।
আমাদের জন্য তারা খাবার তৈরি করলো। রাতে আমাদের ১১ জনকে খাওয়ালো পরম আন্তরিকতার সাথে। ১২ টা থেকে আমাদের কাজ শুরু হলো। পাথর উঠানো, এক্সপ্লোসিভ বসানো, সার্কিট লাগানো। আমি প্রধান বিষয়গুলো বলে দিলাম। জহির পরিকল্পনাটা তাদেরকে বোঝালো। হাতে একটা স্টেনগান নিয়ে আমি একপাশে দাড়িয়ে কাভার দিচ্ছি যদি কেউ আসে। অন্য দিকে একজনকে পাহারায় পাঠিয়ে দিলাম। ভিতরে কাজ হচ্ছে পুরোদমে। রাত আড়াইটা বা তিনটার দিকে এতো জ্বর আসলো যে আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। আমি জহিরকে বললাম ‘এই ব্যাপার । জ্বরে আমি তো দাঁড়াতে পারছি না’।
পাশেই আমাদের বড় নৌকা পাট ক্ষেতে রেখে এসেছি । এখানে এসেছি ছোট নৌকা নিয়ে রাস্তার পাশে ।জহির আমাকে বললো ‘জয়নাল ভাই, আপনি বড় নৌকায় চলে যান’। আমি বললাম ‘আমি চলে যাই কিন্তু তুমি পারবা ঠেকাতে?’ সে খুব জাদরেল প্রকৃতির মানুষ। আমি চলে গেলাম। ভীষণ অস্থিরতায় অপেক্ষা করছি। প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। এভাবে এক সময় ৫.৩০টা বাজে। ৬টায় আসবে ট্রেন। আমরা সবাই তাকিয়ে আছি নিশ্বাস বন্ধ করে। ৬টা বাজার ৫ মিনিট আগে শুনলাম হুইসেল দিয়েছে। ট্রেনের সামনের ইঞ্জিনে পাথরের বগি থাকে। তারপর সিভিলিয়ানদের বগি। আবার কিছু মালামালের বগি আছে।
আমরা গাড়ির পজেটিভ নেগেটিভ ব্যাটারি নিয়ে গিয়েছিলাম। পজেটিভ নেগেটিভ এক করলেই বিস্ফোরণ ঘটবে। জহির সেই তারটা টেনে এনেছিল খালের এই পাড়ে একটা বট গাছের কাছে। সেখানে সে, আদু এবং ফারুক এই ৩ জন ঝোপের মধ্যে অবস্থান নিয়ে আছে। ট্রেন আসার পর তার লাগিয়ে দিয়েছে এবং ঠিক সে সময়ই প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এটা সে সময়ের সবচেয়ে বড় অপারেশন বাংলাদেশে। সমস্ত জায়গায় যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার, ইন্ডিয়া, ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসিতে প্রচার হয়ে গেল এবং মানুষের মধ্যে সাহস-উদ্দীপনা বেড়ে গেল।
খুব সম্ভবত এটার উপর ভিত্তি করেই আমাকে খেতাব দেওয়া হয়। তবে আমার বক্তব্য এই যে খেতাব এটা আমার ব্যক্তিগত না । এটা আমার প্লাটুনকে দেওয়া। নিয়ম অনুযায়ী দিতে তো হবে একজনকে তাই আমাকে দিয়েছে। আসলে এটা আমার প্লাটুনের প্রাপ্য । আমি এটা বলতেই ভালোবাসি যে এটা আমার ব্যক্তিগত খেতাব নয় বরং এটা প্লাটুনের খেতাব ।
যুদ্ধ শেষের দিকে অর্থাৎ অক্টোবর বা নভেম্বরের দিকে একটা লোকের সাথে পরিচয় হয়। তিনি বাটার ম্যানেজার মিষ্টার ওডারল্যান্ড।
আমার সাথে প্রথম পরিচয় হয় । কারণ তার ফ্যাক্টরিতে কিছু লোক আমার দলের ছিল। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিক ছিলেন। তখন তিনি আমার পরিচিতদের বলেছিলেন ‘আমাকে কিছু মুক্তিযোদ্ধার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও’। গুলশানেই তার বাসা ছিল। তখন গুলশান ছিল অনেকটাই বিল এলাকা। বিশ্বরোডের এপাশে নৌকা আসে না। তার কথা শুনে আমি আর জহির নৌকায় করে আসলাম। আসার পর একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই সাথে একটা আশা নিয়ে আসলাম যে কিছু অস্ত্রশস্ত্র পাই যদি। আমাদের কিছু কেমিকেল দরকার ছিল। তিনি ডেনমার্কের লোক হলেও অষ্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপও আছে।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি কি চাও আমার কাছে’। আমি বললাম ‘আমি যেটা চাইবো সেটা খুব দুস্প্রাপ্য জিনিস। তুমি কি দিতে পারবা?’ তিনি বললেন ‘হ্যাঁ ,বলো’। আমি তাকে বললাম ‘তুমি আমাকে কিছু পটাশিয়াম সায়োনেট বা বিষ দাও’। তিনি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি করবা’। আমি বললাম ‘এই বিষ ক্যাপসুলের মধ্যে ঢুকিয়ে জামার কলারে লাগাবো। যদি কোন দিন ধরা পড়ি অন্তত এটা টেনে মুখে দিতে পারবো। তাহলে অত্যাচার সহ্য করার আগেই মারা যাবো’।
তিনি অবাক হয়ে প্রায় ২ মিনিট চুপ করে রইলেন। কি বলছে এই ছেলে! আমি বললাম ‘আমার অস্ত্রশস্ত্র আছে তাই এগুলো দেওয়া লাগবে না এবং আমার ছেলেরা ৩ বেলার জায়গায় একবেলা খাই। ২ বেলা খেতে পারি না। পাবো কোথায়! তাই পারো যদি সাহায্য করো’। সেই ভদ্রলোক কিছু সাহায্য করলেন আমাকে। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধু হিসেবে সাহায্য করার জন্য পরবর্তীতে তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি বীর প্রতীক খেতাব পান।
সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত