ডাইনোসর বিলুপ্তির নতুন মতবাদ

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর “বিলাসী” গল্পে বলেছিলেন, “অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে।” অতিকায় হস্তী বলতে তিনি ম্যামথকে বুঝিয়েছেন, অর্থাৎ ম্যামথের মত বিশাল প্রাণী কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে কিন্তু তেলাপোকার মত ক্ষুদ্র এবং পায়ের নিচে চাপা পড়ার মত প্রাণী ঠিকই টিকে আছে। আজ থেকে প্রায় ১০০০০ বছর আগেই ম্যামথরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাদের আগে পৃথিবীতে রাজত্ব করে বেড়াতো যে বিশাল প্রাণী ডাইনোসর, তারাও কিন্তু টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে গেছে। প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন বছর পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করার পর আজ থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসর নামক রাজকীয় প্রাণীরা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।

ডাইনোসরের বিলুপ্তির পেছনে অনেকে অনেক ধরণের মতবাদ দিয়ে থাকেন। তবে বিংশ শতাব্দীতে বেশীরভাগ বিজ্ঞানীরাই ধারণা করেন যে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পেছনে দায়ী হল আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন। তুষার যুগ বা Ice Age নামে পরিচিত সময়টিই ডাইনোসরদের বিলুপ্তির জন্য দায়ী বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। একই সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমে যাওয়া, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বেড়ে যাওয়া, মহাদেশগুলোর বিভাজন এবং ঘন ঘন বেশ কিছু উল্কাপাতও এর জন্য দায়ী। তবে সবাই এ ব্যাপারে একমত যে ডাইনোসররা ছিল বিশালাকার এক প্রাণী যারা ১৬৫ মিলিয়ন বছর দাপটের সাথে পৃথিবীতে বেড়িয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে অন্য প্রাণীদের সাথে হেরে গিয়ে বিলুপ্ত হয়। অর্থাৎ টিকে থাকতে হলে শুধু বিশাল আর শক্তিশালী হলেই চলে না, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতাও টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এবার আসা যাক ডাইনোসর বিলুপ্তির নতুন মতবাদের কথায়। বিজ্ঞানীরা ধরেই নিয়েছিলেন যে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগের Ice Age-ই হল ডাইনোসরদের বিলুপ্তির কারণ, কিন্তু সম্প্রতি একদল জাপানী বিজ্ঞানী “Gondwana Research” নামক এক জার্নালে একটি নতুন মতবাদ প্রদান করেছেন। তাঁরা বলছেন যে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর চারপাশে বিশাল এক Interstellar Cloud বা মহাজাগতিক মেঘের সৃষ্টি হয়। Interstellar Cloud বা মহাজাগতিক মেঘ বলতে মহাকাশে বিভিন্ন পদার্থ বা গ্যাসের ফলে সৃষ্ট ঘন মেঘকে বোঝানো হয়। এই মহাজাগতিক মেঘ এতই ঘন ছিল যে তা পৃথিবীর তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং তার ফলে পৃথিবীতে তুষার যুগের সৃষ্টি হয়।

এই বিজ্ঞানীর দল প্রশান্ত মহাসাগরে ইরিডিয়াম নামক এক পদার্থ খুঁজে পেয়েছেন যার দলাটির ঘনত্ব ছিল প্রায় ১৬ ফিট। ইরিডিয়াম পৃথিবীতে সহজলভ্য নয়, বিজ্ঞানীদের মতে, ইরিডিয়াম হল এমন এক পদার্থ যা পৃথিবী পৃষ্ঠজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর ইরিডিয়ামের ঘনত্ব সর্বোচ্চ ১ ফুট হতে পারে যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরে খুঁজে পাওয়া ইরিডিয়ামের ঘনত্ব ১৬ ফিট। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এটা নিশ্চয়ই মহাকাশ থেকে ছুটে আসা উল্কার একটি অংশ যা মহাজাগতিক মেঘ থেকে ছিটকে এসেছিল।

এই বিজ্ঞানীর দল ধারণা করছেন, ৬৫ মিলিয়ন বছর আগের Ice Age এই মহাজাগতিক মেঘের ফলেই ঘটেছিল। এই মেঘটি প্রায় এক মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ঘিরে ছিল, যার ফলে পৃথিবীর যতটুকু তাপমাত্রা প্রয়োজন ছিল, তা পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় নি, এবং এর ফলে তুষার যুগের শুরু হয়। এখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল Global Warming বা বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে গত ৮ মিলিয়ন বছর পৃথিবীর তাপমাত্রা কেবল কমেই যাচ্ছিল।

যদিও এই জাপানী বিজ্ঞানীদের ধারণা অন্য বিজ্ঞানীরা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না, কিন্তু তাঁদের মতবাদ প্রমাণ করার মত তেমন যুক্তিও তাঁরা এখনও দেখাতে পারেন নি। এটা ঠিক যে Interstellar Cloud সৃষ্টি কোন নতুন ধারণা নয়, মহাকাশে এমন মেঘের সৃষ্টি বেশ স্বাভাবিক, কিন্তু ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে আসলেই এমন মেঘ সৃষ্টি হয়েছিল কিনা তা প্রমাণ করতে আরও গবেষণার প্রয়োজন। যে ইরিডিয়াম নিয়ে জাপানী বিজ্ঞানীরা বলতে চাইছেন যে এটি পৃথিবীর অংশ নয়, তা মানতে অনেক বিজ্ঞানী নারাজ। এটা ঠিক যে পৃথিবীর অন্য কোথাও এত ঘনত্বের ইরিডিয়াম পাওয়া যায় নি, তাই বলে আর কখনও পাওয়া যাবে না এমন তো নয়। বিশাল এই পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানি!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন