আমাদের বীরগাথা

ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-

মেজর জেনারেল (অবঃ) আমিন আহমেদ চেীধুরী, বীর বিক্রম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তার গ্রামের বাড়ি তদানীন্তন ছাগলনাইয়ার ফেনী মহকুমার পরশুরাম থানার অন্তর্গত আনন্দপুর গ্রামে। তার পিতা মরহুম সুলতান আহমেদ চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারের একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন এবং মাতা মরহুমা আজিজুননেছা ছিলেন গৃহবধু। মেট্রিক পাশের পর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন । ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর আবার ময়মনসিংহে ফিরে গিয়ে আনন্দমোহন কলেজে বিএসসি’তে ভর্তি হন। বিএসসি পড়া অবস্থায় তিনি ১৯৬৫ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর তিনি ১১ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
………………………………………………

“১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সামরিক অফিসাররা মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যাই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। আমি ১৪ মার্চ ঢাকায় যাই। উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার পরিস্থিতি অনুধাবন ও সিনিয়রদের সাথে যোগাযোগ করা। প্রথমেই জেনারেল ওসমানীর ধানমণ্ডির বাসায় গেলে তার ব্যাটম্যান আমাকে বললো ‘স্যার হাইড আউটে (গোপনস্থানে) আছেন। দেখা হবে না।’ খুব ধমক দেবার পর সে আমাকে একটি ছেলের কাছে নিয়ে গেল। আমার কথা শোনার পর ওই ছেলেটি আমাকে একটি ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে ধানমণ্ডিরই অনেক অলিগলি ঘুরিয়ে শেষে নিয়ে গিয়ে থামালো একটি দোতলা বাড়ির সামনে।

আমি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারলাম যে গাড়িটি থামানো হয়েছে জেনারেল ওসমানীর বাড়ির পাশেরই আরেকটি বাড়ির সামনে। অনুমান করলাম বাড়িটি কোন বিচারকের বাড়ি এবং যে ছেলেটি আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে গেল সম্ভবত সে ওই বিচারকেরই ছেলে। ওই বাড়িতে গিয়ে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো। তার সঙ্গে আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। জেনারেল ওসমানীসহ উপস্থিত সকলকে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানালাম।

জেনারেল ওসমানীসহ উপস্থিত যারা ছিলেন সবাই আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে ঘণ্টাখানেক আলোচনা করেন। তারপর বললেন ‘দেখো, বিশ্বজনমত যদি আমাদের পক্ষে আনতে হয় তাহলে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে আমাদের জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না।’ এটা শুনে আমি বললাম ‘পাকিস্তান ভেঙ্গে দুই টুকরো করার চিন্তা আমাদের পরিকল্পনায় নেই। কিন্তু পাকিস্তানিরা যদি অতর্কিতে আমাদের উপর আক্রমণ করে বসে তাহলে আমরা কীভাবে আত্মরক্ষা করব সেটাই আমাদের পরিকল্পনার মূল বিষয়।’ জেনারেল ওসমানী তখন বললেন ‘ঠিক আছে তোমরা মানসিক ভাবে তৈরি থাকো কিন্তু অপেক্ষা করো।’

কামালপুর, নকশি, বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণ হলো পরপর। কামালপুরে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ৩১ জুলাই মারা যায়। বাহাদুরাবাদে শাফায়াত জামিল এবং নকশি বিওপিতে আমি দায়িত্বে ছিলাম যুদ্ধ পরিচালনায়। নকশি বিওপি জামালপুরের শেরপুর পাকিস্তান আর্মির কত লোক আছে সেটা বের করার জন্য আমরা একটা পেট্রোল গ্রুপ পাঠালাম। আমি নিজেও গেলাম। তিনদিন অনবরত রেকি করে যে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, সামনে-পেছনে কি আছে হিসাব করলাম। আর গারো পরিবারের মাধ্যমে কুক ধরে আনালাম। কুকও গারো।সে জানালো যে আগে নকশি বিওপিতে ৪৫ জন আর্মি ছিল যাদের রুটি বানাতে হতো তাকে।

৩১ তারিখের কামালপুরে আক্রমনের পর মোট ৬৫ জন অর্থাৎ তারা আরো দুই সেকশন যোগ করেছে। এখন সবমিলিয়ে ৯০ জনের মতো আছে এই দুইদিনে। আর বাকি সবাই আনসার, রাজাকার, আর সিএফ বলে (রিটায়ার্ড আর্মি পারসন)ওয়েস্ট পাকিস্তান থেকে ট্রুপস আনা হয়েছে। তাদেরকে নিয়ে ১৬০/১৭০ জন হতে পারে। দুইদিন রেকি করার পর তৃতীয়দিন রেকি করে ফেরার সময় আমরা শালবনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছি । পাহাড় থেকে নামার সময় হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ হলো। গুলি করা হয়েছে মনে করে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে পজিশন নিলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আসল ঘটনা বোঝা গেল। একটা গারো মেয়ে আমাদের দেখে আড়াল নিয়েছে। এতো চমৎকার লাগলো। দেখে মনে হলো যেন মেয়েটা শিক্ষিত কোনো সৈনিক।

সে সময় একদিন মাথার নিচে স্টিলের হেলমেট দিয়ে শুয়ে আছি তখন শামসুল নামের এক ছেলে এসে বললো ‘স্যার, আপনার হাবিলদার আমাকে ল্যাট্রিন কাটতে দিয়েছে’। কথা শুনে মনে হলো সে ছাত্র। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তুমি কি ছাত্র?’ সে বললো ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। এসএম হলে থাকি’। আমি বললাম ‘তুমি তো এখন সিপাহী। তোমাকে যা করতে বলা হবে তাই করবে’।

সে বলল ‘আমি জানি স্যার’। তারপর সে যা বললো তা হলো আগের দিন হাবিলদার অস্ত্রের ওপর ক্লাস নিচ্ছিলো। রাইফেলের বিভিন্ন ব্যাপার দেখাচ্ছিল। হাবিলদারকে ওস্তাদ বলা হয়। তারা তেমন শিক্ষিত হতো না। হাবিলদার ট্রিগারকে বলছিল টাইগার। তখন শামসুল বললো ‘ওস্তাদ, টাইগার না, ট্রিগার’। তখন হাবিলদার রেগে গিয়ে তাকে সবার সামনে ১০০ বার টাইগার বলতে বললো। কিন্তু তাতেও তার রাগ পড়লো না। সকালে উঠে শামসুলকে ল্যাট্রিন কাটার দায়িত্ব দিল।

আমি তাকে বললাম ‘ঠিক আছে আমি বিষয়টা দেখবো। কিন্তু তোমরা ওস্তাদের কথা মানো।  তোমাকে যা করতে বলেছে তাই করো’। আমি হাবিলদারকে ডেকে বললাম ‘একজন তোমাকে একটা জিনিস শেখাচ্ছে, তুমি শিখবে না কেন?’ সে বললো ‘স্যার, এটা আমার মুখ দিয়ে আসে না, আমি কি করবো?’ যুদ্ধের ময়দানে যখন গেলাম তখন আমার হাতে-পায়ে গুলি লেগেছে। আমি ক্রল করে ফিরে আসছিলাম । বামদিকে তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা মৃত পড়ে আছে।

আরেকটা ছেলের কথা না বললেই নয়। সালাম নামে বাচ্চা একটা ছেলে যার উচ্চতা এলএমজিটার সমান। তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তািনরা। সে একা জীবিত। তাকে বললাম ’তোমার যুদ্ধে যাবার দরকার নেই’। আমি যখন অ্যাসেম্বলি এরিয়াতে গেলাম তখন আমরা প্রথমে একত্র হই । তারপর এ্যাটাক করি। সেখানে গিয়ে দেখি ওই ছেলে উপস্থিত। আমার যখন গুলি লাগায় পিছিয়ে আসছি তখন বামদিকে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা একটা এলএমজি তুলে দৌঁড় দিয়েছে। তাকে বললাম ‘আমি উইথড্রলের অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। তুমি যেওনা, আমাদের কোন লোক নেই তাই চলে আসো’। সে ফিরে না এসে দুইদিকে গুলি করতে করতে ৫০/৬০ গজ এগিয়ে গেল। আমাকে একজন গুলি করতে আসছিল তাকে মারলো। এরপর পুরো ব্লাস্ট হয়ে গেল। আমি মাটিতে গড়িয়ে আরেকদিকে সরে গেলাম।

এছাড়া আমার সাথে আরেকটা বিহারী ছেলে ছিল হানিফ নামে। সে সময় যুব ক্যাম্প, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প তদারকিতে যেতাম। যুব ক্যাম্পে কোনো ভালো ছেলে দেখলে রিক্রুট করে নিয়ে আসতাম। কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে ইপিআরের কয়েকটা ছেলের সাথে বিহারী ছেলে হানিফকে দেখলাম।

জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে’। হানিফ বলল ‘স্যার, আমার বাড়ি বরিশাল। ইপিআরে ছিলাম। আমি ডিউটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জয়েন করেছি। কিন্তু আমি যেহেতু ভালো বাংলা বলতে পারি না তাই আমাকে ভারতের কাছে হ্যান্ডওভার করেছে’। সে আরো বললো ‘সাব, আমি বেঈমান না। আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমার স্ত্রী বাঙালি। ছেলে-মেয়েরা বাংলায় কথা বলে, বাংলা স্কুলে পড়ে। আমি যুদ্ধ করতে পারব। যুদ্ধটা আমার নয়। কিন্তু যুদ্ধটা আমার পরিবারের এবং আমি, আমার স্ত্রী ও আমার ছেলের প্রতি দয়া করো। এই সুযোগটা আমাকে দেন। আমি ভালো বাংলা বলতে পারি না এটা আমি স্বীকার করছি’।

আমি অনেক চিন্তা করলাম। অন্যরা জানালো সে একেবারে খাস বিহারী। আমি বললাম অসুবিধা তো নাই এটা স্বীকার তো করতেই হবে। আমি বললাম ‘আসো, তুমি যেহেতু প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত লোক সেহেতু তুমি আমার  বডিগার্ড হিসেবে থাকো’। সে বলছে আমার জীবন থাকা অবস্থায় আপনার গায়ে গুলি লাগবেনা। তখন বোধহয় ১০ গজ বাকি আছে। আমরা পাকিস্তানের ফার্ষ্টলাইন ডিফেন্স উড়িয়ে দিয়েছি একদম পুরা জয়বাংলা বলে।

বামদিক থেকে নাসির নামে একটা প্রচন্ড সাহসী ছেলে ছিল । নাসির পাকিস্তান আর্মির আর্টিলারীর হাবিলদার ছিল। সে বামদিকে দুইটা ট্রেঞ্চ উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে অলরেডি ঢুকছে। ওই সময় শেল গো ফায়ার অর্থাৎ ১৮ টা গান দিয়ে বা ৬টা মর্টার দিয়ে একসাথে ফায়ার করে এবং ফায়ারটা আকাশে ব্লাস্ট করে। আমরা যেহেতু এ্যাটাক করছি তাহলে উপর থেকে যদি আসে আমাদের গায়ে লাগবেই।

অন্যথায় যদি মাটিতে ব্লাস্ট করে তাহলে আড়াই ফিট উপরে দিয়ে এটা চলে যায়। শুয়ে পড়লে এটা লাগবেনা। কিন্তু এয়ার থেকে যদি এয়ার ব্লাস্ট করে এবং যদি সে সময় কেউ এ্যাটাক করতে যায় তাহলে অবশ্যই লাগবে। ওখানে ৩৫ জন একই সময় পড়ে যায়। যেখানে হাবিলদার নাসিরের গলাটা উড়ে যায়। সে খুব শক্তিশালী ছিল। খুব ধড়ফড় করছিল মারা যাবার আগে। আমাদের ৩৫ জন একই সময় আহত হয়ে কেউ কেউ মারা গেল। আমাদের এ্যাটাকটা সেখানে গিয়ে থেমে গেল। তখন আর দশগজ বাকি। ওই অবস্থায় উঁচু জায়গায় মাথাটা উঁচু করে দেখছি আর নিচে হানিফ আমাকে কাভার দিচ্ছে।

হানিফ আমাকে হিন্দিতে বলছে ‘আমি কভারিং ফায়ার করছি আপনি পিছনে চলে যান’। সেখানে দুইবার বলছে সে এই কথাটা। এর মধ্যে আমার শরীরে একটা মর্টার শেল এসে লাগে। সুতরাং আমি পড়ে যাই। এর মধ্যে হানিফ আমাকে বলছে ‘স্যার এখনও সময় আছে আপনি চলে যান’। আমার মাথায় ষ্টিল হেলমেট আর তার মাথায় গামছা। আমাদের ষ্টিল হেলমেট বেশি ছিল না। ওখানে পাকিস্তানি এম পি পোষ্টে একজন ছিল। আমি বললাম যে ওই ব্যাটাকে আগে শেষ কর নইলে আমরা উইথড্র করতে পারবো না।

আমিও চেষ্টা করছিলাম গুলি করতে। সে সময় দেখলাম যে আরেকটা গুলি এসে আমাদের মাটির যে ঢিবি ছিল সেটা উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমি  হানিফকে বললাম ‘ওরা কিন্তু আমাদের অবস্থান বুঝে ফেলেছে। সুতরাং আমাদের এই অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে’। হানিফ বলছে ‘ আগে আপনি চলে যান তারপর আমি যাবো’। আমি একটু পেছন দিকে যেতেই একটা হিসিং শব্দ হল। শরীরের একটা অংশ উড়ে গেল হানিফের। আমি পেছন থেকে ধাক্কা দিলাম। হানিফ, হানিফ করে ডাকলাম। কোন উত্তর পেলামনা । কারন এরমধ্যে সে শহীদ হয়েছে।

আমি ক্রলিং শুরু করলাম । এসময় আমার হাতে গুলি লাগে ফলে আমার ষ্টেনগানটা পড়ে যায়। আমি বাম হাতে ষ্টেনগান নিয়ে এবং ড্রেসিং কাপড় দিয়ে বাঁধতে চেষ্টা করলাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু এটা অতটা বোঝা যাচ্ছিল না। আমি গড়াতে আরম্ভ করলাম। গড়াতে গিয়ে দেখি তখন আর কেউ বেঁচ নাই। মানুষ মরে একেবারে ছারখার হয়ে গেছে। যখন গড়াতে আরম্ভ করলাম তখন আমি দেখি যে আসলে আমি পাকিস্তানিদের দিকে চলে যাচ্ছি। আমি চিন্তা করলাম যে মাথা ঠান্ডা করে আগে দিকটা দেখি। দেখলাম হালুয়াঘাটের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম আমাকে বিপরীত দিকে যেতে হবে। হালুয়াঘাটের রাস্তার উপর দিয়ে গরুর গাড়ি দিয়ে কে যেন যাচ্ছে। গড়ানো আরম্ভ করলাম। কিছুদুর আসার পরে আরেকটা ধান ক্ষেতের ভেতরে এক জওয়ান বলছে নোয়াখালির ভাষায় ‘ আঁই বাঁচতে চাই। আঁরে লই যাও।’ তার পেটে গুলি লেগেছে। আমি বললাম,‘ব্যাটা চিৎকার করিস না’।

পাকিস্তানিরা মপিং আপ অপারেশন করে। ওখানে একটা মাটির দেওয়াল ছিল। দেওয়ালের পেছনে গিয়ে তারা পুরো এ্যাটাক করছে আমাদের উপর। যতজনকে পারছিল ততজনকে মেরে ফেলেছে। ঐ লোককে বলার সাথে সাথে দেখি যে দুইটা আর্র্টিলারী শেল এসে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সে উড়ে গেল। আমি গড়িয়ে আরেকটা ধানক্ষেতে চলে গেলাম। তখন অল্প পানি সেখানে। পানির ভেতর থাকাতে শরীর একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে।

ধানক্ষেতে আসার পর যখন ধানক্ষেত শেষ হয়ে গেল তখন খোলা উন্মুক্ত জমি আর পাশে শালবন। আমাকে শালবন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আটটা দশ বাজে। আমরা রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশের সময় এ্যাটাক করছি। এই দীর্ঘসময় আমি ধানক্ষেতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আর তারা আমাকে খুঁজছে। যেহেতু হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে সেহেতু পানির উপর দিয়ে রক্তের একটা স্রোত বইছিল। সেটা ধরে ধরে তারা আগাচ্ছে। আমাকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে তখন চর্তুদিক থেকে। সেই মুর্হূতে মেজর আমিনুল হক (মারা গেছেন কিছুদিন আগে) যিনি আমার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন।

মোদাচ্ছের আর তিনি আমার খোঁজ করতে আসছেন এবং আমার কালো শার্ট  আর কালো প্যান্ট দেখে তারা আমাকে চিনতে পেরেছেন। আর্টিলারী শেলিং এ বিরাট গর্ত হয়েছে। আমি ওই গর্তের ভেতরে ঢুকে কালো কাদা দিয়ে সমস্ত শরীরটা মেখে ষ্টেনগানটা বামহাতে নিয়ে বসে আছি যে পাকিস্তানি আর্মি আসলে ধরা দেবো না। তারা গুলি করলে আমিও গুলি করবো। সে সময় তার সাথে দেখা। তিনি আমাকে বললেন ‘আমিন চিন্তা করো না আমরা আসছি’ এবং আমিও সাদা রুমাল দিয়ে একটু দেখালাম কারন আমাকে ঠিক মতো দেখা যাচ্ছিলো না। সেই মুর্হূতে মেজর আমিনুল হক ক্রল করে আমার কাছে এলেন ।

সাথে নায়েক তাহের ছিল (মারা গেছে)। সেও পিস্তল নিয়ে আমার কাছে আসছে। এসে তারা আমার ষ্টেনগানটাকে আমার পায়ের সাথে বেঁঁধে ষ্ট্রেচারের মত করেছে যেহেতু পাটা নিয়ে আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না। একটু উপরে তুলে আমাকে আস্তে আস্তে টানতে আরম্ভ করেছে। মোদাচ্ছের তখন দুই শালবনের উপরে দুইজনকে দুইটা এলএমজি দিয়ে গাছের অনেক উপরে তুলে দুদিক থেকে তাক করে রেখেছে। এলএমজিওয়ালারা তখন কাঁদছে আর বলছে ‘স্যার, তারা কিন্তু আপনাদের ধরে ফেলছে প্রায়। এখন যদি আমরা গুলি করি তাহলে আপনাদের গায়েও গুলি লাগতে পারে। কারন ওরা এসে গেছে আপনাদের কাছে। আমরা তাদের কথাবার্তা শুনছি’।

সেখানে পাকিস্তানিদের গাইড ছিল মকবুল। মকবুল বলছে ‘এধার আও, এধার আও মিল গিয়া’। তখন আমিনুল হক দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলছেন ‘ব্যাটা গুলি লাগুক ধরা পড়ার চেয়ে তো ভাল হবে আর যাই হোক। তুই গুলি কর। যা হয় দেখবো’। তখন তারা গুলি করা শুরু করেছে। একেবারে একই সময় চারটা মেশিনগান ফায়ার করেছে। সেই মুর্হূতেই ১২ জন লোক মারা গেছে পাকিস্তানের আর দুজন আহত। কিন্তু আল্লাহর রহমত যে আমাদের কারো গায়ে গুলি লাগেনি। আশেপাশে দিয়ে গুলি চলে গেছে কিন্তু কারো গায়ে লাগেনি। আমিনুল হক প্রথমে আমাকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে নালাতে পড়ে গেলেন।

আমি তখন তাকে বললাম ‘আপনি চলে যান আমরা দুইজন অফিসার একসাথে আহত হলে মুক্তিবাহিনীর জন্য খারাপ হবে’। তিনি যেতে চাইলেন না। তাহের খুব শক্তিশালী ছিল। ভালো বক্সার ও সাতাঁরু ছিল। তারপর তাহের আমাকে কাঁধে নিয়ে দিল দৌড়। একদম বৃষ্টির মত আর্টিলারী শেল আসছিল তখন। সে আমাকে কাঁধে নেওয়ার পর বললো ‘চিন্তা করবেন না স্যার মরলে দুইজন একসাথেই মরব’।

সে এটা বলার সাথে সাথে মনে হল যেন একটা শান্তির প্রলেপ পেলাম। তার কাঁধে মাথাটা দিয়ে আমার প্রায় জ্ঞান চলে গেল। এর আগে আমি সবসময় এ্যালার্ট ছিলাম যে জ্ঞান হারাতে পারবনা কারণ আমাকে বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এরপর আমি তো ময়দান থেকে চলে গিয়েছি। এদিকে মকবুলসহ আরও একজন রাজাকার ধরা পড়ে। তাদেরকে খুব মেরে আধামরা করে ফেলেছিল। তারা বলেছিল ‘স্যার আমরা দুইটাকার জন্য এই কাজ করছি’। আমি পরে শুনেছি যে তারা আমাদের পক্ষে গাইড হিসেবে কাজ করেছে। তাই তাদেরকে হ্যান্ড ওভার করা হয়নি।

সূত্র : ‘৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়’- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন