আমাদের বীরগাথা

ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-
রমজান আলী শেখ এবং মোছাম্মৎ খায়রুন্নেসার সন্তান বীরপ্রতীক আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার দিয়ার ধানগড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের তীব্র গণআন্দোলন ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি সিরাজগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের একজন সদস্য হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দেয়া সকল কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তিনি সিরাজগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
……………………………………………….

নাগরপুর যুদ্ধে কাদেরীয়া বাহিনীর অস্ত্র ছিল ২টি তিন ইঞ্চি মর্টার, ২০টি দুই ইঞ্চি মর্টার, ২টি ব্লান্ডার সাইট, ২টি রকেট লঞ্চার, ৫টি এমজি, ৩০টি এলএমজি, ২০টি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল, ভারতীয় ও চাইনিজ এসএমজি এবং থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণ।

আমাদের কোম্পানি অর্থাৎ হুমায়ূন কোম্পানির দায়িত্ব ছিল নাগরপুর থানার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করা। আমাদের কোম্পানিতে ছিল ছয়টি ইন্ডিয়ান ও দুটি চাইনিজ এসএমজি, দুটি দুই ইঞ্চি মর্টার, দুটি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল, অবশিষ্ট থ্রি নট থ্রি ও চাইনিজ রাইফেল। কাদেরীয়া বাহিনীর এতো অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকার কারণ হলো ভুয়াপুরের মাটিকাটায় ২১ কোটি টাকার পাকিস্তানি অস্ত্রসহ একটি জাহাজ আক্রমণ করেন কাদেরীয়া বাহিনীর হাবিবুর রহমান নামের এক কোম্পানি কমান্ডার তার যোদ্ধাদের নিয়ে।

তিনি সেনাবাহিনীর একজন সুবেদার ছিলেন। পরবর্তীতে ওই ঘাটটির নাম হয়ে যায় জাহাজমারা ঘাট। আর হাবিবুর ভাইকে আমরা ডাকতে শুরু করি জাহাজমারা হাবিব (তিনি পরবর্তীতে বীরবিক্রম উপাধি পান)। ওই জাহাজ থেকে আমরা প্রচুর অস্ত্র পেয়েছিলাম যা দিয়ে পরবর্তীতে কাদেরীয়া বাহিনীর অনেকগুলো কোম্পানি সাজানো হয়েছিল। এই কারণে আমাদের কাছে যে পরিমাণ চাইনিজ এসএমজি, রাইফেল, এলএমজি ছিল তা বাংলাদেশের অন্য কোনো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ছিল না।

পূর্বপরিকল্পনা অনুয়ায়ী ৩০ নভেম্বর দুপুর ১২টায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকীর নির্দেশে ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা ছুড়ে নাগরপুর থানার যুদ্ধ শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোও গর্জে ওঠে। নাগরপুর থানা যুদ্ধটা এমন ছিল যে টাঙ্গাইল জেলার আর কোনো যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এতো বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে হয় নাই। কারণ আমাদের লক্ষ্য ছিল যে করেই হোক এই যুদ্ধে জয়ী হতে হবে।

নাগরপুর থানায় এক কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে সমসংখ্যক রাজাকারও ছিল। এখানে বলে রাখি, এই যুদ্ধে একটি কৌশলগত কারণে আমরা সফল হইনি। কারণ যুদ্ধের একটি কৌশল হল চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের সময় একটি দিক খোলা রাখতে হয়। যাতে শত্রুবাহিনী সেই পথে পালিয়ে যেতে পারে অথবা নিজেরাও পশ্চাদপসরণ করতে পারে। বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী আমাদের কোম্পানির ওপর নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধ করার পাশাপাশি আমাদের একটা প্লাটুন পশ্চিম দিকে আরো পিছিয়ে চুপচাপ অস্ত্র নিয়ে বসে থাকবে। কোনো ফায়ার করবে না।

যখন পাকিস্তানিরা আমাদের প্রবল আক্রমণের মুখে ওই পথ দিয়ে পালাতে শুরু করবে তখন আমাদের প্লাটুনের যোদ্ধারা পাকিস্তানিদের জীবন্ত ধরবে। আমাদের যে প্লাটুনটিকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তার প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম নান্নু। তার বাড়ি গোপালপুরের পানকাতায়। সে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নান্নু আমাদের সঙ্গে আরো অনেক যুদ্ধ করেছে। তুমুল গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর তারও হাত-পা নিশপিশ করছিলো।

এ কারণেই সম্ভবত অতিরিক্ত উত্তেজনায় নান্নু একটা ভুল করে বসে। গোলাগুলি শুরু হওয়ার পরও অস্ত্র হাতে চুপচাপ বসে থাকাটা কঠিন। তাই যখন আমাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা দিশেহারা তখন আমি দেখলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাঙ্কার ছেড়ে ক্রল করে পশ্চিম দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক এই সময় নান্নুর হাতের এলএমজি থেকে ট্রিগারে চাপ পরে এক ঝাঁক গুলি বেরিয়ে যায়।

এটা নান্নু অতিরিক্ত উত্তেজনায় অথবা ভুল করে ট্রিগারে চাপ দিয়েছিল। তার গুলির শব্দ শুনেই পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার ক্রল করে বাঙ্কারে ফিরে গিয়ে মরণপণ যুদ্ধ শুরু করে। ফলে যুদ্ধটা আমাদের জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ পাকিস্তানিরা বুঝে গেছে তাদের পালাবার পথ নেই। ইতোমধ্যে আমাদের কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি থানার বেশ কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম।

কিন্তু পাকিস্তানিরা যখন ওদের সুরক্ষিত বাঙ্কারে অবস্থান নিয়ে আবার প্রবল গুলি আরম্ভ করলো স্বভাবতই আমাদের আবার পিছিয়ে আসতে হলো। এর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করছিল সবুর খানের কোম্পানি। যখন উভয় পক্ষের গোলাগুলি তুঙ্গে তখন সবুর খান একটা চিরকুট পাঠালেন আমার কাছে। তাতে লেখা, ‘পাহাড়ী আপনি আপনার গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল নিয়ে এসে এখানে দুটো বাঙ্কার ভেঙে দেন।’

সবুর ভাই জানতেন আমাদের কোম্পানিতে গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল আছে এবং ওটা আমি নিজেই চালাই। আমি আমার গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল ও গ্রেনেড জ্যাকেট নিয়ে সবুর খানের কাছে সড়কের পাশে চলে আসলাম। আমার কাছে তখন দুটি গ্রেনেড জ্যাকেট ছিল। একেকটি জ্যাকেটে ৬টি করে গ্রেনেড থাকে। আমি যখন সবুর খানের কাছে আসি তখন আমার কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ূন বাঙ্গালও আমার সঙ্গে আসলেন।

তিনি নিজেই বললেন, ‘চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।’ কারণ গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল সাধারণ রাইফেলের মতো নয়। যদি কোনো বাঙ্কারের ভেতরে গ্রেনেড ঢুকাতে হয় তাহলে এই রাইফেলের পেছন অংশ থাকে ‘বাঁট’ বলা হয় সেটা কোনো গাছ বা দেয়ালের সঙ্গে বাঙ্কারের সমান্তরালে জিরো অ্যাঙ্গেলে সোজাসুজি সেট করতে হয়। এরপর গ্রেনেড ছুড়তে হয়। এ সময় রাইফেলের পেছনের বাটটা কোনো সহযোদ্ধাকে চেপে ধরতে হয়।

রাইফেলের পাশেই মিটার সেট করা আছে। লক্ষ্যস্থলে গ্রেনেড আঘাত হানলে মিটারে তা দেখা যায়। উভয় পক্ষে তখন তুমুল গোলাগুলি চলছে। সবুর খানের হাতেও এলএমজি ছিল। তিনি তার এলএমজি থেকে গুলি ছুড়ছিলেন। খুব সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। পাকিস্তানিরা এ সময় আমাদের মা-বোনকে উদ্দেশ্য করে উর্দুতে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল। ব্যাপারটি আমার খুব গায়ে লেগেছিল।

আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য ছিলেন। তাদের কাছ থেকে গালিগুলোর বাংলা অর্থ আমরা আগেই জেনে নিয়েছিলাম। তারাও তার জবাব দিচ্ছিলেন। আমি আর হুমায়ূন বাঙ্গাল সবুর খানের কাছে পোঁছলে তিনি আমাকে দুটো বাঙ্কার দেখিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে ক্রমাগত এলএমজি ফায়ার আসছে আপনি এই দুটো বাঙ্কার ভেঙে দেন।’

আমি তখন পজিশন নেয়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিলাম। এ সময় দেখি সড়কের ওপর একটা জিগার গাছ। খুব বেশি মোটা না। আমি গাছটি পেয়েই যুদ্ধের কলাকৌশল ভুলে উত্তেজনায় লাফিয়ে সড়কে উঠে গেলাম। গাছে ঠেস দিয়ে গ্রেনেডের পিন খুলে গ্লাসে ঢুকিয়ে রাইফেল লোড করে বাঙ্কারের সমান্তরালে সেট করে মিটারে চোখ রাখলাম। দেখলাম একদম জিরো ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল হয়েছে।

ট্রিগারে চাপ দিয়ে প্রথম একটি বাঙ্কারে গ্রেনেড ছুড়লাম। এ সময় হুমায়ূন বাঙ্গাল রাইফেলের বাঁট চেপে ধরেছিলেন। দেখলাম গ্রেনেডটি ঠিক বাঙ্কারের ভেতরে গিয়ে পড়ে বিস্ফোরিত হলো। বুঝলাম সেখানে অবস্থান করা যে পাকিস্তানি এলএমজিম্যান তার টু-আইসি শেষ। কারণ ওই বাঙ্কার থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সবুর খান আমাকে বাহবা জানিয়ে বললেন, ‘পাহাড়ী ভাই খুব ভালো হয়েছে। ব্যাটা তো মারা পড়েছে।

আপনি ওই আরেকটি বাঙ্কার ভেঙে দেন।’ আমি একই পজিশনে পাশের বাঙ্কারে গ্রেনেড ছোড়ার জন্য রাইফেলটিকে সেট করলাম। আগের মতো পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে যখন ট্রিগারে চাপ দেবো ঠিক তখনি দেখলাম বাঙ্কারের ভেতরে হেলমেট পরা ইয়া মোচওয়ালা সৈন্যটি তার এলএমজির ব্যারেলটি আমার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। আমি সড়কের ওপরে মর্টার পজিশনে বসা। সঙ্গে সঙ্গেই গুলিটি আমার গলা ছুঁয়ে মুখে আঘাত করলো এবং একই সঙ্গে আমার পেছনে হুমায়ূন বাঙ্গাল যিনি বাঁট ধরেছিলেন তার পিঠের মাংস ভেদ করে দুটি গুলি বেরিয়ে গেলো।

গুলি লাগার পর আমার মনে হলো লক্ষ কোটি জোনাক পোকা আমার চোখের সামনে। চারদিকে ভোঁ ভোঁ শব্দ। আমি তখন বুঝতে পারছিলাম আর কিছুক্ষণ পরেই আমি মারা যাবো। আবার এটাও মনে হলো যদি আমি এখানে পড়ে থাকি তাহলে আমার সহযোদ্ধারা আমার লাশ পাবে না। পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবে। আমার কোমরে তখন মোটা বেল্ট ছিল।

কয়েকমাস আগে নদীতে পাকিস্তানি সৈন্য মেরে আমরা তাদের বেল্ট নিয়ে নিয়েছিলাম। আমি সেই বেল্টে ভর করে সবুর খান রাস্তার যে পাশে সেই পাশে লাফিয়ে পড়লাম। এরপর কয়েক মিনিট আমার জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফেরার পর দেখি সবুর খানের কোলে আমার মাথা। 

শুনছি সবুর ভাই বলছেন, ‘পাহাড়ী ভাই এবার মারা যাবেন।’ আমি চুপচাপ আছি। আমার কানের কাছে ঝরনার কুলকুল শব্দ সেই কুলকুল শব্দে রক্ত আমার গলার ভেতরে ঢুকছে। আমি বাম হাত এগিয়ে দিলাম। অনুভব করলাম দাঁত বেরিয়ে গেছে। মাথা ফুলে গেছে। আমি বুঝতে পারছি একটু পরেই মৃত্যু। মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছি। মনে হচ্ছিল চারপাশের কথাগুলো অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমার এটাও মনে হলো এরা যদি আমাকে মৃত ভেবে এখানে ফেলে রেখে যায় তাহলেও তো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আমি মারা যাবো। তাই আমি অস্ফুটভাবে বললাম, ‘আমি মরিনি।’ এ কথা বলার পরপরই সবুর ভাই বলে উঠলেন, ‘এই পাহাড়ী তো মরেনি।’ এদিকে হুমায়ূন বাঙ্গালও গুলি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। তারা আমাকে কাঁধে করে কাছেই একটা বাড়িতে নিলো।

একবারে দরিদ্র গৃহস্থের বাড়ি। একটা টিনের ছাপড়া ঘর। তখন গ্রামের বাড়ির দরজাগুলোতে কাঠের কপাট থাকতো। স্ট্রেচার বানানোর জন্য তখন এই কাঠের কপাটই আদর্শ উপকরণ। বাড়ির কর্তা নিজেই তার ঘরের দরজার কপাট খুলে দিলেন। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে দড়ি দিয়ে স্ট্রেচার বানিয়ে দিলেন। সহযোদ্ধারা আমাদের দুজনকে স্ট্রেচারে শোয়ালো। আমি চিত হয়ে এবং  আমার কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ূন বাঙ্গাল উপুড় হয়ে।

আমাদের বহন করে নিয়ে যেতে হলে দুই বিঘা জমির মতো ফাঁকা জায়গা পেরুতে হবে। কিন্তু সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওইটুকু জমি পেরুতে গেলেই পাকিস্তানিরা আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে। তখন আমাদের সহযোদ্ধারা কাভার এন্ড ফায়ার পদ্ধতিতে চলে গেলো। এক দল ফায়ার করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখলো এবং আরেক দল আমাদের নিয়ে এগিয়ে গেলো।

এইভাবে ওই জায়গাটুকু পার হয়ে সন্ধ্যার একটু আগে নদীপথে আমাদের নিয়ে আসা হলো তৎকালীন ১৯৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত এমএনএ শওকত ব্যারিস্টার সাহেবের গ্রামের বাড়িতে। তখন মির্জাপুর নাগরপুর দুটি নির্বাচনী এলাকা এক ছিল। তাদের বিশাল বাড়ি। সেই বাড়ির সামনেই তাদের করা স্কুলের পাশের আম গাছের নিচে আমাদের এনে রাখা হলো। রক্তে ভিজে গেছে সারা শরীর। কথা বন্ধ হয়ে গেছে।

সন্ধ্যার দিকে হাতে হারিকেন নিয়ে একজন এলএমএফ ডাক্তার আসলেন আমাদের কাছে। তার সঙ্গে ১৫-১৬ বছরের একটি মেয়ে। তিনি এসে আমাদের দুজনকে দেখলেন। আমার মাথা তখন ফুলে গিয়ে চেহারা বীভৎস হয়ে গেছে। তিনি আমার পাশে এসে বসলেন। আমি তার পকেটে কলম দেখে ইশারায় কাগজ-কলম চাইলাম। তিনি কাগজ-কলম দিলে আমি তাকে লিখে দিলাম ‘গলা থেকে রক্ত বের করে দিন।’

তিনি আমার লেখা দেখে বললেন, ‘কোন মায়ের ছেলেরে বাবা! এখনই মারা যাবে।’ কথাগুলো বলেই তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি চলে গেলেন। এরপর আমাদের ব্যারিস্টার শওকত আলীর কাচারি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে জলচৌকির ওপর গদি আঁটা। তাতে আমাকে আর হুমায়ূন বাঙ্গালকে শোয়ানো হলো। রাত ৮টার কিছু পরে একটু জ্ঞান ফিরে এলো। কোনো বোধশক্তি নেই শরীরের। নভেম্বর মাস। রক্তে ভিজে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এ সময় সেখানে দুজন মানুষ আসলেন।

একজন হচ্ছেন তৎকালীন কালিহাতী থানা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। জনাব আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই। তখনও তার গায়ে থেকে ছাত্রনেতার গন্ধ যায়নি। তিনি ৭০ সালেই প্রথম নমিনেশন পেয়েছিলেন। আরেকজন হচ্ছেন ডাক্তার শাহজাদা। টাঙ্গাইলের বাসাইল থানার কাউলজানীতে তার বাড়ি। তিনি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র।

পরবর্তীতে তিনি বড় ডাক্তার হয়েছেন এবং নিপসামের পরিচালকও ছিলেন। তিনি আমার মুখে সেলাই করলেন। কোনো এনেসথেসিয়া ছাড়াই। সেলাইয়ের শেষ দিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাহাড়ী তোমার ব্যথা লাগছে না।’ একই সঙ্গে শুনলাম ডাক্তার শাহজাদা লতিফ সিদ্দিকীকে বলছেন, ‘দাদা ওর মাথার কাছেই মুখে গুলি লেগেছে তো। জায়গাটি এখন বোধশূন্য হয়ে গেছে। তাই ব্যথা পাচ্ছে না।’

আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই বাড়িতে বিশাল ফুলের বাগান ছিল। সেই বাগান থেকে দুটো গোলাপ ছিড়ে এনে লতিফ সিদ্দিকী প্রথমেই একটি আমার হাতে দিয়ে খুব সুন্দর করে বললেন, ‘পাহাড়ী বেঁচে গেছিস। আর মরবি না।’ বলেই তিনি হেসে ফেললেন। আরেকটি তিনি হুমায়ূন বাঙ্গালের হাতে দিলেন। এরপর তারা চলে গেলেন। আমরা সেখানেই রইলাম।

সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন