প্রায় ৭১ সেন্টিমিটার উচ্চতার স্ট্যাম্পের ভিতরে যেসব প্রযুক্তি লুকিয়ে আছে তা ভাবলেই অবাক লাগে ! আসলে ক্রিকেটে প্রযুক্তির ব্যবহার দিনে দিনে যেভাবে বাড়ছে, তাতে এটি কেবল খেলোয়াড়দের খেলা নয়, প্রযুক্তির খেলাও বটে ! বলের গতি, বল করার পদ্ধতি, বাউন্ডারি হল কিনা প্রভৃতি জটিল বিষয়গুলো এখন খুব সহজেই আম্পায়ারের চেয়ে প্রযুক্তির হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখানে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে বিষয়ে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে তা হল আউটের ব্যাপারে। রান আউট, স্ট্যাম্পিং, বাউন্ডারির কাছাকাছি কট আউট অথবা বোল্ডের বেলায়ও বল স্টাম্প আলতো করে ছুঁয়ে গেলে নির্ণয় করা কষ্ট হয়ে পড়ে যে আউট হল কিনা। এসব ব্যাপার এখন খুব সহজেই বের করা যায় ক্রিকেটের অতি উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে।
সম্প্রতি ক্রিকেটে যে নতুন প্রযুক্তি সাড়া ফেলেছে তা হল LED স্ট্যাম্প। অস্ট্রেলিয়ান প্রকৌশলী ব্রন্ট একারম্যান হলেন এর উদ্ভাবক। এই স্ট্যাম্পের বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে LED বাতি যুক্ত করা হয়েছে। স্ট্যাম্পে বল লাগলেই বেল পড়লেই এই বাল্বটি জ্বলে ওঠে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, স্ট্যাম্পের ভিতরে Gyroscope Sensor থাকে যা মূলত বেলের সূক্ষ্মতম নড়াচড়া বলে দিতে পারে। তাই, স্ট্যাম্পে বল লাগলেই যদি বেল উপরে উঠে তাহলে লাল বাতি জ্বলে ওঠে আর তখন বেল পড়ে যাওয়া মানে ব্যাটসম্যান আউট।
আগে যেমন ম্যাচ জিতার পর বিজয়ী দল স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে উদযাপন করতো, এখন হয়তো সেটি আর হবে না। একটি ম্যাচে পুরো এক সেট স্টাম্প স্থাপন করতে মোট খরচ হয় প্রায় ৪০,০০০ USD, খুব যে সস্তা তা বলা যাবে না। প্রায় ৩ বছর গবেষণার পর অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে এই স্ট্যাম্প উদ্বোধন করা হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ২০১৪ T20 বিশ্বকাপ থেকে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ক্রিকেটে প্রতিটি স্টাম্প লম্বায় ২৮ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ৯ ইঞ্চি হয়ে থাকে।
বিভিন্ন ম্যাচে আমরা স্ট্যাম্পে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টিকার দেখতে পাই, আসলে যেসব প্রতিষ্ঠান খেলায় স্পন্সর হিসেবে কাজ করে, তাদের প্রচারণা বাড়াতেই স্ট্যাম্পে তাদের স্টিকার লাগানো থাকে। সাধারণ স্ট্যাম্পে অনেক সময় বল আলতো করে লাগলে বেল নাও পড়তে পারে এবং এক্ষেত্রে আম্পায়ারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া বেশ কঠিন। কিন্তু এই স্ট্যাম্পে যুক্ত Gyroscope Sensor বল লাগা মাত্রই তা অনুভব করতে পারে এবং বাতি জ্বালিয়ে সংকেত দেয়। বাতিগুলো জ্বলে ওঠার জন্য এতে নিম্ন ভোল্টেজের ব্যাটারি সংযুক্ত করা আছে। এই স্ট্যাম্পগুলো মিশ্র প্রকৃতির প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্লাস্টিক বলে যে এগুলো কাঠের চেয়ে কোন অংশে কম শক্ত তা কিন্তু নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে এগুলো কাঠের স্ট্যাম্পের চেয়েও বেশী টেকসই।
স্নিকোমিটার (Snickometer) হলো একটি খুবই সংবেদনশীল মাইক্রোফোন, যা কোনো একটি স্টাম্পে যুক্ত থাকে। যখন বল ব্যাটের প্রান্ত মৃদুভাবে ছুঁয়ে অতিক্রম করে যায়, যা সাধারণত বোঝা যায় না সেই শব্দ ধারণ করে এই স্নিকোমিটার। বল সত্যিকার অর্থে ব্যাটে আঘাত করেছে কি না, সে সম্পর্কে তথ্য টেলিভিশনের দর্শকদের সামনে তুলে ধরতেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। তবে খেলার মাঝখানে বিভিন্ন ধরণের শব্দ হতে পারে যা বল ব্যাটে লাগার শব্দকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সাউন্ড ওয়েভ ব্যবহার করে সঠিক শব্দটি খুঁজে বের করা হয়। স্নিকোমিটার প্রথম আবিষ্কার করেন ইংলিশ বিজ্ঞানী অ্যালান প্লাস্কেট ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। স্নিকোমিটার প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যের Channel 4। পাশের ছবিতে আমরা দেখছি কিভাবে স্ট্যাম্পের পিছনে মাইক্রোফোনটা থাকে।
তবে মাঠে খেলোয়াড়রা যা কথা বলে তা Mute করে রাখা হয়। এই মাইক্রোফোনটা ব্যবহারই করা হয় যেন ব্যাটে বল লাগলো কিনা তা বুঝার জন্যে।
এটা সত্য যে বেশিরভাগ ক্রিকেটপ্রেমী যুক্তি দেখাবেন যে, আরাম করে টিভির সামনে বসে খেলা দেখার চেয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখা অনেক আনন্দ ও উপভোগ্য। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি এ ধারণা পাল্টে দিয়েছে। কেননা, ক্রিকেট মাঠের প্রত্যেক প্রান্তের শেষে সেট করা থাকে ন্যূনতম ১৬টি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা, যা সম্ভাব্য সব প্রান্তের ছবি গ্রহণ করতে থাকে। এই ক্যামেরাগুলো শুধু টেলিভিশন সম্প্রচারকে সমৃদ্ধ করেছে তাই নয়, বরং গ্রাফিক্যাল টেকনোলজির সহায়ক হিসেবেও কাজ করছে। এই প্রযুক্তি থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এ ধরনের সুবিধা স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা পাবেন না।