চাঁদের কলঙ্ক আছে, সেটা সবাই জানি; কিন্তু চাঁদের আবার গন্ধকী! চাঁদ কি ফুল, নাকি কোরমা-পোলাও যে চাঁদের গন্ধ থাকবে? এমন প্রশ্ন নিয়ে যারা ভুরু কুঁচকে আছ, তাদের বলতে চাই, চাঁদেরও গন্ধ আছে।শুনতে অবিশ্বাস্য আর বিদঘুটে মনে হোক, এটাই সত্যি! কিন্তু সেই গন্ধ কেমন? এ ব্যাপারে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার বিভিন্ন অভিযানের নভোচারীদের বক্তব্য মোটামুটি অভিন্ন।তবে তা নিয়েই জট পাকিয়েছে আরেক রহস্যের। সেই গল্পটাই বলছি, শোনো।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে অ্যাপোলো ১৭ নামের নাসা তৃতীয়বারের মতো পরিচালনা করেছিল চন্দ্রঅভিযান।এ অভিযানে চাঁদে নেমেছিলেন মার্কিন নভোচারী জিনকারন্যান।তিনি চাঁদের ধুলোবালি পরীক্ষা করে জানান, সেগুলো তুষারের মতো নরম, তবে রুক্ষ।স্বাদ ও মন্দ নয়। তবে গন্ধটা? ঠিক পোড়া বারুদের মতো,যেন সেখানে কেউ এইমাত্র রাইফেলের গুলি ছুড়েছে। এই অভিযানের আরেক নভোচারী মার্কিন জীববিজ্ঞানী জ্যাকস্মিটেরও একই ভাষ্য।
নভোচারী হিসেবে প্রশিক্ষণের সময় তাঁদের অনেকবার গুলি ছুড়তে হয়। তাই বারুদের গন্ধ নিয়ে তাঁদের কোনো সন্দেহ নেই। স্মিটওকারন্যান চাঁদে হাঁটতে গিয়ে তাঁদের পোশাক, গ্লাভস আর জুতায় চাঁদের ধুলোবালি আঠার মতো লেগে গিয়েছিল। নভোযানে ফিরে সেগুলো ব্রাশ করে ঝাড়তে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল তাঁদের।এসময়ই তাঁদের নাকে চাঁদের গন্ধ প্রথম ধরা পড়ে।
অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের আটমাস আগে এপ্রিলে চন্দ্র অভিযানে গিয়েছিল নাসার অ্যাপোলো ১৬।এ অভিযানের একমাত্র নভোচারী চার্লস ডিউক ও চাঁদে পোড়া বারুদের গন্ধ পেয়েছিলেন।কিন্তু তখন বিষয়টি আমলে না নিলেও অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের পর তা বিশ্বাস করতে শুরু করে নাসা। কিন্তু এই গন্ধের কারণ কী? জবাব খুঁজতে গিয়ে গবেষকেরা দেখেছেন, চাঁদের মাটিতে বারুদের কোনো উপাদান নেই। প্রাচীনকালে পটাসিয়াম নাইট্রেট (সল্টপিটার), চারকোল আর সালফারের মিশ্রণ দিয়ে বানানো হতো বারুদ বা গান পাউডার। আর আধুনিক ধোঁয়াবিহীন বারুদে থাকে নাইট্রোসেলুলোজ ও নাইট্রোগ্লিসারিন।
কিন্তু চাঁদের মাটিতে এমন দাহ্য পদার্থ নেই। এর মূল উপাদান সিলিকন ডাই-অক্সাইড, যা চাঁদে আছড়ে পড়া উল্কা থেকে কোটি কোটি বছরে তৈরি হয়েছে।এছাড়া আছে উচ্চমাত্রার লোহা, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম খনিজ। এর কোনোটিই বারুদের উপাদান নয়। বারুদের একটি জিনিসই আছে চাঁদে। সেটি সালফার, তা-ও পরিমাণে নগণ্য, মাত্র শূন্য দশমিক ২শতাংশ; যেখানে বারুদে সালফার ১০শতাংশ। তাহলে এ গন্ধের উৎস কী?
এই রহস্যের ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন নভোচারী ডনপেট্টিট। তাঁর মতে, মরুভূমিতেও শুরুতে গন্ধ পাওয়া যায় না। কিন্তু বৃষ্টি নামলেই মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভরে যায়।পানির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা মাটিতে অনেকদিন আটকে থাকা অণুগুলোনাকে বয়ে আনে। চাঁদের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই ঘটতে পারে। কারণ, চাঁদ ও কোটি বছরের পুরোনো মরুভূমির মতো অবিশ্বাস্য রকম শুকনো। লুনার মডিউলের ভেতর এসব ধূলিকণা ভেজা বাতাসের সংস্পর্শে এসে মরুভূমির বৃষ্টির মতোই আচরণ করে। তখনই গন্ধটা নাকে লাগে।
এ ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নাসার জনসন স্পেস সেন্টারের লুনার স্যাম্পল ল্যাবরেটরির গবেষক গ্যারিল ফগ্রেন।তাঁর ধারণা, চাঁদের ধূলিকণা থেকে বাষ্পীভূত গ্যাসের উৎস হয়তো সৌর বাতাস। সূর্য থেকে উষ্ণ হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আর অন্য আয়ন চাঁদে আসে।এসব আয়ন চন্দ্র পৃষ্ঠে আঘাত হানলে তা ধূলিকণার মধ্যে ঢুকে যায়।
তাঁর এ ব্যাখ্যা মেনে নিলে স্বীকার করতে হবে, এটি শুধু চাঁদের গন্ধ নয়, সূর্যের গন্ধও বটে।তাই সূর্যের গন্ধ পেতে চাইলে যেতে হবে সেই চাঁদে। বিভিন্ন চন্দ্র অভিযানে কয়েকশ পাউন্ড চাঁদের মাটি, ধূলিকণা, পাথর পৃথিবীতে এনেছেন নভোচারীরা। সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে লুনার স্যাম্পল ল্যাবে রাখা আছে। কিন্তু রহস্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, এসব নমুনা হাজার শুঁকেও কোনো গন্ধ পাওয়া যায়নি।তাহলে কি গন্ধের ব্যাপারটা পুরোটা ধাপ্পাবাজি? নভোচারীদের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা? এ ব্যাপারে গ্যারিল ফগ্রেনের ধারণা, মাটি আনার সময় নভোযানের আর্দ্র বাতাসে বাষ্পীভূত হয়ে মিশে গেছে, গায়ে মাখা সুগন্ধি যেভাবে বাতাসে মিলিয়ে যায়।এ সমস্যা সমাধানে পরবর্তী সময়ে থার্মোস ভ্যাকুয়াম কনটেইনারে চাঁদের নমুনা এনেছেন নভোচারীরা।
তবে দুর্ভাগ্য, সেবার ফিরতি পথে চাঁদের চোখা ধূলিকণার আঘাতে কনটেইনারের সিল নষ্ট হয়ে যায়। তাই চাঁদের গন্ধ আর পৃথিবীতে আনা যায়নি। তাই এ গন্ধ-রহস্যের সমাধান চাঁদে বসেই করার কথা ভাবছেন গবেষকেরা। ২০১৮ সালে চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা থাকলেও তা বাতিল করেছে নাসা। তবে ২০২০ সালে আলাদাভাবে উপগ্রহটিতে মানুষ পাঠাবে ভারত ও জাপান। তাই তার আগে এ রহস্যের জট খুলছেনা, সেটা নিশ্চিত।