বিজ্ঞান নিয়ে অনেকের মনেই ভয়ভীতি থাকে। জটিল সব সূত্র, গাণিতিক ব্যাখ্যা আর কাঠখোট্টা সব শব্দ শুনলেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। জটিল সব ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে সহজভাবে তুলে ধরার কাজটিই করছে সায়েন্স রকস টিভি অনুষ্ঠানটি। প্রতি সপ্তাহে ২টি করে ৫২ সপ্তাহে মোট ১০৪টি মজার মজার সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট দেখানো হবে তোমাদের আর বলে দেয়া হবে সেটা কেন হলো, কিভাবে হলো। আজ এক ঝলক জেনে নেয়া যাক সায়েন্স রকস টিভি অনুষ্ঠানের চতুর্থ পর্বে দেখানো পানির পৃষ্ঠটান পরীক্ষাটি।
আমরা সবাই জানি এবং দেখেছি যে, পানির উপর ছোট ছোট পোকামাকড় বা মাকড়শা হেঁটে বেড়ায়। এটা সম্ভব হয় একমাত্র পানির পৃষ্ঠটানের জন্য। পানির অণুগুলো একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। পানির অণুগুলো একটি আরেকটির উপর চাপ সৃষ্টি করে আর এই পারস্পরিক চাপের ফলেই তৈরি হয় পৃষ্ঠটান। পানির বা যেকোন তরলের মজার একটি ধর্ম হচ্ছে তরল পৃষ্ঠ সর্বদাই সঙ্কুচিত হয়ে সর্বনিম্ন ক্ষেত্রফলে আসতে চায়। তরলের মধ্যে যে বলের প্রভাবে এই বিশেষ ধর্ম প্রকাশ পায় সেই বলকেই পৃষ্ঠটান বলে। পানির এই পৃষ্ঠটান পরীক্ষা করার জন্য আজ দুইটি এক্সপেরিমেন্ট বা পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করবো আমরা।
Pepper On The Run:
কি কি লাগবেঃ
Pepper On The Run পরীক্ষাটিতে আমাদের লাগবে Pepper বা গোল মরিচের গুঁড়ো (একদম মিহি না), পানি, বাটি ও তরল সাবান বা লিকুইড সোপ।
কিভাবে করবোঃ
প্রথমেই একটি বাটি নিতে হবে এবং বাটিতে পরিমাণ মতো পানি ঢালতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, পানি যেন বাটি থেকে উপচে না পড়ে। পানি ঢালা শেষ হয়ে গেলে কিছু পরিমাণ গোল মরিচের গুঁড়ো বা Pepper পানির উপরে ছড়িয়ে দিতে হবে। মরিচের গুঁড়ো ছড়ানো হয়ে গেলে এবার আসল পরীক্ষার পালা। এবার সামান্য পরিমাণ লিকুইড সোপ বা তরল সাবান (এক ফোঁটা) আঙ্গুলে নিয়ে বাটির পানির ঠিক মাঝখানে স্পর্শ করতে হবে। WoW !! দেখা যাবে, সব মরিচের গুঁড়ো খুব দ্রুত গতিতে বাটির কিনারার দিকে সরে গেছে। এমনটা কেন হল ?? হ্যাঁ, এবার বিজ্ঞানের গবেষণা থেকে সেটাই জানবো।
কেন হলোঃ
পৃষ্ঠটানের জন্য যেমন পানির উপর ছোট ছোট পোকামাকড় বা মাকড়শা হেঁটে বেড়াতে পারে তেমনি এই পরীক্ষায় গোল মরিচের গুঁড়ো পানির উপরে ভাসছে পানির পৃষ্ঠটানের কারণেই। পৃষ্ঠটানের কারণে তরলের মুক্ত পৃষ্ঠে স্থিতিস্থাপক পর্দার টানের ন্যায় একটা টান ক্রিয়া করে। পানির পৃষ্ঠটান অন্যান্য তরলের তুলনায় বেশি থাকে কেননা পানির অণুগুলো একে অপরের সাথে খুব ভালোভাবে সম্পৃক্ত থাকে। যখন আমরা লিকুইড সোপ বা সাবানকে পানিতে স্পর্শ করি তখন তরলের আংশিক রাসায়নিক চার্জ পানির আংশিক রাসায়নিক চার্জকে বিকর্ষণ করে এবং তার ফলেই পানিতে সাবান স্পর্শ করলে পানির উপরে ছড়ানো গোল মরিচের গুঁড়োগুলো আকস্মিক বাটির কিনারার দিকে চলে যায়। এখানে, লিকুইড সোপ Surfactant হিসেবে কাজ করছে যা তরলের পৃষ্ঠটানকে কমিয়ে দেয়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে যে, মরিচের গুঁড়োর সঙ্গে সাবানের কোন সম্পর্ক নেই, যেহেতু পানিগুলো কিনারার দিকে সরে যায় তাই পানির উপরে ভাসমান ঐ মরিচের গুঁড়োগুলোও সরে যায়।
এবার আসা যাক পানির পৃষ্ঠটান সম্পর্কিত দ্বিতীয় পরীক্ষাটিতে যার নাম রঙিন দুধ।
রঙিন দুধঃ
কি কি লাগবেঃ রঙিন দুধ পরীক্ষাটি করার জন্য আমাদের লাগবে একটি বাটি, দুধ, তিনটি আলাদা খাবার রঙ, কটন বার্ড এবং লিকুইড ওয়াশিং সোপ। সবগুলো উপকরণ কিন্তু আমাদের বাসাতেই পাওয়া যায়।
কিভাবে করবোঃ পরীক্ষার শুরুতে প্রথমে একটি বাটিতে পরিমাণমত দুধ নিতে হবে। ফ্রিজের ঠাণ্ডা দুধ হলে পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ হবে না, তাই সাধারণ তাপমাত্রার দুধ নিলে ভালো হয়। এবার, বাটিতে খাবার রঙ দেবার পালা। এই পরীক্ষায় আমরা তিনটি আলাদা রঙের খাবার রঙ নিয়েছি। একফোঁটা করে তিন রঙের দুই থেকে তিন ফোঁটা খাবার রঙ দুধের উপর বাটির চারদিকে দিয়ে দিবো। খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিটি খাবার রঙের ড্রপ যেন খুবই সামান্য হয়। তাই, খাবার রঙের ড্রপের জন্য আমরা ড্রপারের সাহায্য নিতে পারি। কি দেখছো? খাবার রঙের ড্রপ দুধের উপর ভেসে আছে, তাই না? এবার ঘটবে আসল ঘটনা। একটি কটন বার্ড নিয়ে তাতে অল্প পরিমাণ লিকুইড ওয়াশিং সোপ লাগিয়ে বাটির মাঝখানে দুধের উপর রাখতেই দেখা যাবে খাবার রঙের ড্রপগুলো দূরে সরে গিয়ে দুধের সাথে মিশে গিয়ে অদ্ভুত আল্পনার সৃষ্টি করেছে !! খাবার রঙ যদি বিভিন্ন জায়গায় দেয়া হয় তাহলে বিভিন্ন ধরণের আলপনা তৈরী হবে।
কেন হলোঃ
পানি,তরল বা দুধের একটি বিশেষ ধর্ম হল পৃষ্টটান। তরল পৃষ্টের অণুসমূহ সব সময় একে অপরের সাথে লেগে থাকতে চায়। পৃষ্ঠটানের কারণে পানির উপরটা টানটান অবস্থায় থাকে বা থাকতে চায়।
আমাদের এই পরীক্ষায় ঠিক এভাবেই দুধের উপরের অণুগুলো পৃষ্ঠটান সহ্য করে আটকে থাকে। যখন খাবার রঙ দেয়া হয় তখন দুধের উপরের অণুগুলো পৃষ্ঠটান সহ্য করে আটকে থাকে এবং খাবারের রঙের সাথে মিশে যায় না। আরো একটি কারণ হল, খাবারের রঙের ঘনত্ব দুধের ঘনত্বের চেয়ে কম থাকে। তাই, খাবার রঙের ড্রপ দুধের পৃষ্ঠে ভেসে থাকে। কিন্তু যখন লিকুইড ওয়াশিং সোপ দেয়া হয় তখন দুধ আর খাবার রঙ মিশে আল্পনা তৈরী করে। কেন ?
লিকুইড ওয়াশিং সোপ এ রয়েছে প্রচুর ক্ষার অর্থাৎ ঋণাত্মক আয়নের আধিক্য রয়েছে। অন্যদিকে, দুধের অধিকাংশই পানি যেখানে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ধনাত্মক আয়ন। দুধে লিকুইড ওয়াশিং সোপ মিশাতেই ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আয়ন একত্রিত হয়ে যায়। ফলে দুধের পৃষ্ঠটান ভেঙে যায়। তাই, দুধ খাবারের রঙের সাথে মিশে যায় এবং লিকুইড ওয়াশিং সোপ থেকে দূরে সরতে থাকে।