আসলে যে পরিস্থিতি চলছে শিক্ষাক্ষেত্রে তার প্রধান শিকার হচ্ছে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা। এর সঙ্গে স্কুলের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। সেজন্য সিদ্ধান্তও নিতে হবে তাদেরই যে তারা এই বিরুপ পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করবেন।
আমি জানি এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে। দুরের স্কুল গুলোর নিজস্ব গাড়ি আসে যে গাড়িতে করে তারা বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যায় এবং দিয়ে আসে। তারা খুব স্বাভাবিক কারণেই স্কুল বন্ধ রেখেছে তার কারণ তারা কোনো রিস্ক নেবে না।
আসলে এটা তো একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি। আমরা রোজই বাইরে বের হচ্ছি, রোজই গাড়ি ভাঙ্গচুর হচ্ছে, আগুন দেওয়া হচ্ছে।
আমরা নিজেদের ক্ষেত্রে এই ঝুকি নিতে রাজি থাকি কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কোনো অভিভাবকই এই ঝুকি নেবেন না। আবার স্কুল কতৃপক্ষও কোনো ঝুকি নিতে চায়না বলেই স্কুল বন্ধ রেখেছে।
আর এটাও সত্য আমরা ভয়ে ভয়ে আর কতদিন থাকবো। তাহলে তো আমাদের জীবনযাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা যদি দুই পক্ষের কথাই শুনি তাহলে তো আমাদের গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে।
আর বাচ্চাদের জন্য এর প্রভাবটা আরো ভীতিকর। কারণ ঢাকায় তো এখন বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই। তারা কোথাও যেতে পারে না। স্কুলেই কেবল তারা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে একটু খেলাধুলা করে। তাদের দিনের সবচেয়ে ভালো সময়টা কাটে স্কুলে। সেই জায়গাটা হতে তারা এখন টানা অবরোধে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বঞ্চিত হচ্ছে।
আর বাচ্চাদের মধ্যে হয়তো ভয়টা নিজ থেকে আসে না। বাবা-মার কথাবার্তা বা চারপাশের কে কী বলছে, কোথায় কী হচ্ছে সেটা জেনেই কেবল বাচ্চাদের মধ্যে এই ভয়টা আসে। ওরা যদি টেলিভিশন বা পত্রপত্রিকায় নিউজ দেখে, আগুনে পোড়া রোগি দেখে তাহলে তাদের মধ্যে ভয়টা তৈরি হয়। আর এভাবে যদি ভয়টা ওদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ওরা ভয় পাবে।
অন্যথায় বাচ্চারা বাচ্চাদের মতই থাকে। অন্য কিছূ নিয়ে মাথা ঘামায় না। যখন বাবা-মারা এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে, আলোচনা করে তাদের ভয় বা টেনশনটা বাচ্চারা অনুভব করে। এবং তাদের মধ্যে চলে আসে।
চলমান পরিস্থিতিতে স্কুলের শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা মিলে পজিটিভ এবং নেগেটিভ দিকগুলো আলাদাভাবে ক্ষতিয়ে দেখে সিন্ধান্ত নিতে হবে যে এই পরিস্থিতিতে তারা কী করবেন। তবে সবার আগে কিন্তু বাচ্চার নিরাপত্তার কথাটি সুনিশ্চিত করতে হবে। দুটোর মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে তারপর সিন্ধান্ত নিতে হবে।
আজকে [১৯ জানুয়ারি] একটি বাচ্চার প্রথম স্কুল যে ছিলো কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে সে আর স্কুলে যেতে পারেনি। এতে করে স্কুল জীবনের প্রথম দিনেই সে একটা ধাক্কার সম্মুখিন হলো। যেটা সে সারাজীবন মনে রাখবে।
স্কুল নিয়ে এতদিন ধরে তার ভিতরে যে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো তা ক্রমে ফিকে হতে শুরু করবে তার কাছে। এতে করে মানসিক একটা বিরুপ পরিস্থিতি-ই তৈরি হবে তার মধ্যে।
কোনো ভায়োলেন্স বাচ্চাদের দেখানো উচিত নয়। এটা তাদের সেন্সসিভিটিকে নস্ট করে দেয়। আমরা চাই আমাদের বাচ্চারা সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠুক। কিন্তু তাদের বেড়ে ওঠার এই যদি হয় পরিবেশ তাহলে সে সুনাগরিক হয়ে বেড়ে উঠবে কী করে?
ছেলেবেলাতেই যদি সে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠতে শুরু করে তাহলে বড় হয়েও সে সমস্যার রেশটা থেকে যাবে।
আতঙ্কজনক পরিবেশ বাচ্চাদের সুস্থ্য বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আর ভয়টা একটা জিনিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে তারা সব কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পড়াশোনাতে তো বটেই।
নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বাচ্চাদের পজিটিভ বৃদ্ধির জন্য একটা স্বাভাবিক পরিবেশ লাগবে যেটা এখন নেই। তাই চলমান পরিস্থিতি থেকে যত তারাতারি সম্ভব আমাদের ওঠে আসতে হবে।
ড. মেহজাবিন হক
সহযোগী অধ্যাপক, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়