বেলি ল্যান্ডিং- এই বেলি কোন ফুল নয় বা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিষয় না। এটা আসলে বিমানের একধরণের জরুরী অবতরণের পদ্ধতি। যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম শিখরে বিমান হল এমন একটি যান যা সারা পৃথিবীকে যুক্ত করেছে। কিন্তু বিমান ভ্রমন যেমন সময় বাঁচাতে উপকারী, তেমনি বিপজ্জনকও। বাস বা ট্রেন দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা গেলেও অনেকেই আহত হন বা তেমন আঘাত পান না। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। যদিও আধুনিক বিমানগুলো এতোই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হয় যে এদের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম বললেই চলে। তবুও কিন্তু প্রায়ই বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে এবং অনেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
একটি সাধারণ যাত্রীবাহী বিমান ঘণ্টায় ৯০০-১০০০ কিঃমিঃ বেগে চলে। এই বেগে একটি বিমান কখনোই মাটিতে নামতে পারবে না। বিমান উড্ডয়নের সময় স্থির অবস্থান থেকে প্রয়োজনীয় গতি নিয়ে টেক অফ করে। একটি বোয়িং ৭৩৭ বিমানের ওজন ৪৫৩৬০ কেজির মতো হয়। এই অবস্থায় এটিকে টেক অফ করানোর জন্য কমপক্ষে ২৫০ কিঃ মিঃ গতিবেগ প্রয়োজন। অর্থাৎ মাটিতে থাকা অবস্থায় ২৫০ কিঃ মিঃ গতিবেগ প্রাপ্ত হবার পর এটি উড্ডয়নের জন্য তৈরি হবে। একইভাবে মাটিতে নামার সময়ও বিমানটির গতিবেগ ২৫০ কিঃ মিঃ বা তার কম হতে হবে। এর বেশী হলে বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়তে পারে।
বিমান চালনার বড় চ্যালেঞ্জ হল সঠিকভাবে একটি বিমানকে অবতরণ করানো। বিমানের ককপিটের বাম পাশের সিটটি সাধারণত প্রধান পাইলটের থাকে। বিমান অবতরণ করানোর জন্য প্রথমে বিমানটিকে সমান্তরালভাবে চালাতে হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিমানের গতি কমিয়ে এনে অবতরণের জন্য উপযোগী গতিতে আনতে হয়। এরপর আসছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবার বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার নামাতে হয়।
অনেক বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার সবসময় খোলাই থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রে ল্যান্ডিং অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। ল্যান্ডিং গিয়ার নামানোর পর বিমানটিকে কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে এনে মাটির দিকে অবতরণ করাতে হয়। কিন্তু অবতরণ করানোর পূর্ব মুহূর্তে বিমানের নাকটিকে কিছুটা উঁচু করিয়ে নিতে হয় যাতে অবতরণের সময় প্রথম চাপটি মূল চাকার ওপর দিয়ে যায়। অবতরণের সময় ল্যান্ডিং গিয়ারের ওপর দিয়ে প্রায় ৭০ টনেরও বেশী চাপ প্রবাহিত হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে বিমান অবতরণের সময় গিয়ারের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।
এবার আসি বেলি ল্যান্ডিং এর ব্যাপারে। অনেক সময় বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার আটকে যাবার কারণে অবতরণের সময় ল্যান্ডিং গিয়ার খুলতে পারে না। এমন অবস্থায় বিমানটিকে ল্যান্ডিং গিয়ার ছাড়াই বিমানের মূল বডি বা পেটের ওপর ভর করে বিমানটিকে অবতরণ করাতে হয়। তাই এর নাম বেলি ল্যান্ডিং( Belly Landing )। বেলি ল্যান্ডিং এ বিমানের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে এবং বেশীরভাগ সময়ই বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময়ই বিমান প্রচন্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙ্গে যায় আবার অনেক সময় উল্টে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই যাত্রীদের প্রাণনাশের আশংকা অনেক বেশী। বেলি ল্যান্ডিং ঘটার পেছনে অনেক সময় পাইলটের ভুলও দায়ী। পাইলট যদি বিমান ল্যান্ড করানোর আগে ল্যান্ডিং গিয়ার খুলতে ভুলে যান, তবে বিমানের বেলি ল্যান্ডিং ছাড়া আর পথ নেই। তবে বেশীরভাগ সময় বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই ল্যান্ডিং গিয়ার আটকে যায়।
২০১১ সালের নভেম্বর মাসে পোল্যান্ডে একটি বোয়িং ৭৬৭ বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার আটকে যাবার কারণে পাইলটকে বিমানটিকে বেলি ল্যান্ডিং করাতে হয়। সৌভাগ্যবশতই যাত্রীদের কারও কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এধরণের সব দুর্ঘটনায় বিমানের থাকা মানুষগুলো এতটা সৌভাগ্যবান হন না। ১৯৯৭ সালের দিকে বাংলাদেশ বিমানের একটি যাত্রীবাহী বিমান সিলেট বিমানবন্দরের থেকে একটু দূরে ধানক্ষেতে বেলি ল্যান্ডিং করে, যাতে বিমানের পাইলটসহ সব যাত্রীরাই মারাত্মকভাবে আহত হন। বিমানকে এমন ধরণের দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচানোর উপায় হল বিমানের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ। এছাড়া পাইলটের সঠিক জ্ঞান বড় ধরণের দুর্ঘটনার হাত থেকে বিমানকে বাঁচাতে পারে।