বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স

বিশ্বকাপের যেকোনো পরিসংখ্যান ঘাঁটতে গেলে একটি কথা যোগ করা হয় ‘১৯৬৬ বিশ্বকাপ থেকে’। কারণ, পরিসংখ্যানের হিসাব-নিকাশের দৌড় ওখানেই থামে। কিন্তু ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া ফাইনাল আক্ষরিক অর্থেই ১৯৬৬-র বিশ্বকাপকে টেনে আনল। বিশ্বকাপের ফাইনালে যে ৬ গোল হতে পারে, সেটা জিওফ হার্স্টের হ্যাটট্রিকের দিনেই শেষ দেখেছিল বিশ্ব।

পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে সেই ম্যাচে তবু অনেক নাটক হয়েছিল। ৬ গোলের দেখা পেতে ম্যাচটার যোগ করা সময়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু আজ ৯০ মিনিটেই সব চুকে গেছে। আর এর মধ্যেই ৬ গোল। গত চারটি ফাইনালে ৮ দল মিলিয়ে ৪৫০ মিনিট ফুটবল খেলে ঠিক এই কয়টা গোলই করেছিল!

স্কোরলাইন যে কতটা ভুল বোঝাতে পারে, এর উদাহরণ হয়ে থাকবে এ ফাইনাল। ম্যাচটাকে একপেশে মনে হচ্ছিল শুধু ৬৫ মিনিটে। যখন পেলেকে আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। ৬০ বছর পর বিশ্বকাপ ফাইনাল আরেকজন কিশোর গোলদাতা পেল। ১৯ বছর ৬ মাস বয়সী এমবাপ্পে বিশ্বকাপে নিজেকে চিনিয়েছেন আগেই। ফাইনালে লুকাস হার্নান্দেজের বানিয়ে দেওয়া চমৎকার এক বলে আরও এক চমৎকার শট নিয়ে সেটা রেকর্ড বইয়েও স্থান করিয়ে নিলেন (৪-১)। পেলের পর দ্বিতীয় কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোলের রেকর্ড এখন এমবাপ্পেরই।

৪ মিনিট পরেই ইতিহাসে আরেকজন জায়গা করে নিলেন। হুগো লরিসের হাস্যকর এক ভুলে বল জালে পাঠালেন মারিও মানজুকিচ। বিশ্বকাপের মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই খেলায় গোল ও আত্মঘাতী গোল করে ফেললেন ক্রোয়েশিয়ান ফরোয়ার্ড। ১৯৭৮ সালে নেদারল্যান্ডসের আরনি ব্রান্টের তবু সান্ত্বনা, এ কীর্তি তাঁর ফাইনালে নয়। এদিক থেকে ইতিহাসে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন মানজুকিচ। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ফাইনালে আত্মঘাতী গোল করেছেন সেই ১৮ মিনিটে।

আঁতোয়ান গ্রিজমানের ফ্রি কিক থেকে উড়ে আসা বলে ফ্রান্সের কোনো খেলোয়াড় বল ছুঁতে পারেননি। সে বল আগেই যে মাথা ছুঁয়ে গেছে মানজুকিচের। সুবাসিচকে ধাঁধায় ফেলে দিয়ে বল জালে জড়িয়ে গেল (১-০)। বল দখল, আক্রমণের তীব্রতা—সবকিছুতেই এগিয়ে থাকা এক দল হঠাৎ করেই পিছিয়ে পড়ল! সেমিফাইনালেই নিজেকে ক্রোয়েশিয়ার জনগণের নায়ক বানিয়ে ফেলা মানজুকিচ হঠাৎ করেই বনে গেলেন খলনায়কে।

মানজুকিচ তবু নায়ক-খলনায়কের নাগরদোলায় চড়তে তিন দিনের বিরতি নিয়েছেন। ইভান পেরিসিচ যে সে অভিজ্ঞতা নিলেন মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই। ২৮ মিনিটে বক্সের মধ্যে বল পেয়ে ফ্রান্স রক্ষণকে ব্যবহার করে লরিসকে আড়ালে ফেলে দিলেন। দূরের পোস্টে আশ্রয় নিল বল, টানা চতুর্থ ম্যাচে প্রথমে পিছিয়ে পড়েও সমতায় ফিরল ক্রোয়েশিয়া (১-১)। ৩৮ মিনিটেই সেই পেরিসিচ খলনায়ক। ডি-বক্সে অযথা হাত বাড়িয়ে বল নিয়ন্ত্রণ নিলেন। কিন্তু তাঁর সেই চাতুরী ধরা পড়ে গেল ভিএআরে। পেনাল্টি থেকে ফ্রান্সকে আবারও এগিয়ে দিলেন গ্রিজমান (২-১)। প্রথমার্ধে তাই হাসিমুখেই মাঠ ছেড়েছে ফ্রান্স।

দ্বিতীয়ার্ধেও খেলায় এগিয়ে ছিল ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু বারবার যেভাবে গোলের সুযোগ হাতছাড়া করছিল তারা, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল ভাগ্য আজ ফ্রান্সের পক্ষে। ৫৯ মিনিটেই সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। ডান প্রান্ত দিয়ে বল টেনে নিলেন এমবাপ্পে। তাঁর নিচু ক্রস থেকে গ্রিজমান কিছু করতে না পারলেও সেটা পল পগবার দিকে ঠেলে দিলেন। পগবার ডান পায়ের শট মদরিচের গায়ে লেগে ফিরে এলেও হতাশ হননি। ফিরতি বলে বাঁ পায়ের শট। এবারও পরাস্ত হলেন সুবাসিচ (৩-১)। টানা চতুর্থ মোনাকো গোলরক্ষক হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে পরাজিত দলের গোলরক্ষকের রেকর্ডটাও অক্ষত থাকবে, সেটাও তখন নিশ্চিত হওয়া গেল।

৪ মিনিটের মধ্যে এমবাপ্পে ও মানজুকিচের দুই রেকর্ডের অংশ হওয়া কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। কিন্তু টুর্নামেন্টজুড়ে হিসাবি ফুটবল খেলা ফ্রান্স নিজেদের কোনো বিপাকে পড়তে দেয়নি। উল্টো গোল শোধ দিতে মরিয়া ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রতি আক্রমণে উঠে ব্যবধান বাড়ানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। গতিময় ফ্রান্সের সঙ্গে আর পেরে ওঠা হয়নি ৯০ মিনিট বেশি খেলে ফাইনালে ওঠা ক্রোয়েশিয়ার।

লেখাটি প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন