প্যারাসুটের রহস্য

টিভি বা সিনেমায় আমরা প্রায়ই দেখি প্লেন থেকে কেউ লাফ দিচ্ছে, এরপর পিঠের কাছে একটা ফিতা ধরে টান দিতেই বিশাল পাখির পালকের মতো প্যারাস্যুট খুলে যায়। তারপর, প্যারাস্যুটধারী হেলে-দুলে এরপর মাটিতে নেমে আসেন। আকাশ থেকে  কিংবা মাটির ওপর থেকে পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসার জন্য প্যারাস্যুট ব্যবহার করা হয়। 

মানুষের প্যারাস্যুট ব্যবহারের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো। প্রায় ৫৫০ বছর আগে রেনেসাঁ যুগে প্যারাস্যুট ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তার কোডেক্স অ্যাটলান্টিকাস ( Codex Atlanticus)  বইতে পিরামিড আকৃতির প্যারাস্যুটের ছবি এঁকেছেন। আর এখনকার আধুনিক প্যারাস্যুট ডিজাইন শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর।

প্যারাস্যুটের কাজ করার পদ্ধতি খুব সাধারণ। মাটির ওপর থেকে একটি পালক ও একট পাথর ছেড়ে দিলে পাথরটি আগে নিচে পড়বে, পালক আস্তে-ধীরে নামবে। এর কারণ বাতাসের প্রতিরোধ বা Air Resistance। অভিকর্ষ বলের টানে কোনো বস্তু নিচে নামার সময় এই বাতাসের অণুগুলো বাধা দেয়, তাই প্রতিরোধ তৈরি হয়। পাথর ভারি হওয়ায় ও আয়তন কম হওয়ায় সহজেই অণুগুলোকে সরিয়ে নিচে পড়ে। কিন্তু পালক হালকা হওয়ায় ও এর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল ( Surface Area) বেশি হওয়ায় অণুগুলোকে তেমন সরাতে পারে না, ভাসতে ভাসতে নিচে নামে।

প্যারাস্যুটও ঠিক একইভাবে কাজ করে। সাধারণভাবে কোনো মানুষ উঁচু থেকে লাফ দিলে বাতাসের অণু তেমন প্রতিরোধ করতে পারে না। কিন্তু প্যারাস্যুট খোলামাত্র এতে অণুগুলো আটকা পড়ে। এর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল অনেক বেশি হওয়ায় ও ওজন একেবারে হালকা হওয়ায় অণুগুলো প্যারাস্যুটকে নিচে নামতে বাধা দেয়। ফলে অভিকর্ষ বলের বিপরীত দিকে চাপ দেয়, তাই পড়ার গতি কমে আসে। পালকের মতোই ধীরে-সুস্থে মানুষ নেমে আসতে পারে মাটিতে।

একেবারে সহজ কথায়, ভারী বস্তু দ্রুত মাটিতে পড়ে আর হালকা বস্তু ধীরে পড়ে। প্যারাস্যুট আয়তনের তুলনায় খুবই হালকা হওয়ায় ধীরে পড়ে।

জেনে রাখা ভালো, পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে মৌলিক সূত্রের উপর ভিত্তি করে কাজ করায় প্যারাস্যুট কিন্তু খুবই নিরাপদ। যে কারণে একসময়ের এই সামরিক প্রযুক্তি এখন প্যারাগ্লাইডিং, স্কাইডাইভিং, প্যারাসেইলিং এর মতো খেলাধুলায় ব্যবহার করা হয়।

যারা প্রথমবারের মতো প্যারাসুটে ব্যবহার করে তাদের সাথে একজন প্রশিক্ষক থাকে। এই ধরণের প্রশিক্ষণকে  Tandem Parachuting বলা হয়ে থাকে।

মূলত প্যারাসুটে যারা প্রথমবারের মতো ব্যবহার করে তাদের মধ্যে মানসিক ভয় কাজ করে থাকে। প্যারাস্যুটধারীর এই মানসিক ভয় দূর করার জন্য প্রশিক্ষক তাদের সাথে থাকে। প্রশিক্ষকের মূল লক্ষ্য থাকে প্যারাস্যুটধারীকে প্যারাসুটের বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া। যেমন : প্যারাসুট কখন খুলতে হবে কিংবা কতক্ষণ আকাশে ভাসতে হবে কিংবা মাটিতে ল্যান্ড করার পরে কিভাবে নিজেকে সামলাতে হবে।

প্যারাসুট ল্যান্ড করার জন্য আরেকটি প্রধান বিষয় হচ্ছে ড্রপ জোন চিহ্নিত করা। ড্রপ জোন হচ্ছে কোথায় প্যারাসুটটিকে ল্যান্ড করতে হবে। প্যারাসুটের বিভিন্ন কোণে Cord থাকে। এই Cord কন্ট্রোলের মাধ্যমে একজন প্যারাস্যুটধারী প্যারাসুটের দিক পরিবর্তন করতে পারে। অর্থাৎ, ধরো যদি ড্রপ জোন বাম দিকে হয় তবে প্যারাস্যুটধারী বাম দিকের Cord কন্ট্রোল করে ড্রপ জোনে পৌঁছাতে পারে।

প্যারাসুট খোলার গড় উচ্চতা ধরা হয় ৩০০০-৪০০০ ফিট মাটির উপরে। একজন প্যারাস্যুটধারী যত উচ্চতায় থাকবে তত সময় সে পাবে প্যারাসুট খোলার জন্য।

প্যারাসুট অনেক যত্নসহকারে ভাঁজ এবং ব্যাগে ভরানো হয় যাতে এটি বিশ্বস্থতার সাথে খুলে যায়। যদি প্যারাসুট সঠিকভাবে ব্যাগে ভরানো না হয়, তখন এটি অকার্যকর হতে পারে যার ফলে প্যারাসুট সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে খুলতে ব্যর্থ হতে পারে। উন্নতদেশে জরুরী বা সংরক্ষিত প্যারাসুট রাখা হয় যা প্যারাসুট রিগারদের মাধ্যমে ব্যাগে ভরানো হয়। প্যারাসুট রিগাররা হল যথাযথ মানের উন্নত প্রশিক্ষন এবং প্রশংসাপত্র প্রাপ্ত ব্যাক্তি। যেসব খেলোয়াড় স্ক্যাইড্রাইভ করেন তারা প্রত্যেকেই নিজের প্যারাসুট ব্যাগে ভরানোর জন্য প্রাথমিক প্রশিক্ষন নিয়ে থাকেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন