বসন্তে রক্তরাঙা ফুলে চারপাশ ছেয়ে গেছে। ডালে ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখির দল। প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখ জুড়িয়ে যায় এই দৃশ্য দেখে। ছবিতে দেখলে বাংলাদেশে এমন জায়গা আছে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না। তবে হ্যাঁ, এমনই একটি জায়গা হলো সুনামগঞ্জের শিমুল বাগান।
প্রকৃতিপ্রেমী আর ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে এখন আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠেছে একশ একরের বেশি জায়গাজুড়ে অবস্থিত এই বাগান। জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়বদল ইউনিয়নের এই গ্রামটির নাম মানিগাঁও। গ্রামের পাশেই বহমান জাদুকাটা নদীর তীরেই দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান।
এই শিমুল বাগানে প্রায় ১৪ বছর আগে তিন হাজার শিমুলের চারা রোপণ করেছিলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান বৃক্ষপ্রেমী জয়নাল আবেদীন। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনেক আগেই চলে গেছেন তিনি। কিন্তু তার এই অনন্য কীর্তি রয়ে গেছে আজও।
ফিরে দেখা
স্থানীয় এলাকাবাসীদের মতে, ১২ বছর বয়সে জয়নাল আবেদীন তার পরিবারের সবার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জ জেলার বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। উদ্যমী এই মানুষটি জীবনে অল্প বয়সেই পড়ালেখা ছেড়ে দেন। নানা পেশা বদলে একসময় মৎস্য ব্যবসা শুরু করেন। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইনল্যান্ড ফিশারিজের মাধ্যমে ইজারা নেন টাঙ্গুয়ার হাওর। বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন তিনি।
শুধু ব্যবসা বাণিজ্যে তার মন টিকে থাকেনি। মানুষের কল্যানে কিছু করার চিন্তা করেন। গাছপালার প্রতি ভালোবাসা ছিলো প্রথম থেকেই। তার এই ভালোবাসা ও স্থানীয় সমস্যা মোকাবেলা থেকেই এই বাগান তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি।
হাওরাঞ্চলে বর্ষা এলেই প্রতিনিয়ত পাড় ভাঙতে থাকে। বাড়িঘর ভেসে যায়। আর এটি সমাধানে শক্ত শিকড়ের গাছপালা হলো প্রথম ভরসা। সেসব ভাবনা থেকেই ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় ৯০ হাজার করচ গাছ লাগিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি হিজল গাছও লাগিয়েছিলেন বেশ কিছু। স্থানীয়ভাবেই এগুলোর চারা সংগ্রহ করেন তিনি। শুকনো মৌসুমে নিজেই গাছে পানি দিতেন। এগুলোর যত্নে কখনও কম গুরুত্ব দেননি তিনি।
হিজল করচ লাগানোর পর তিনি ভাবলেন আরও কিছু করার। তাই তৈরি করলেন শিমুল বাগান। ২০০২ সালের দিকে শুরু করেন শিমুল বাগানের কাজ। প্রথমেই নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করে সেখানে প্রাকৃতিক সার দিলেন। এভাবেই প্রস্তুত করে নিলেন মাটি। তারপর সেখানে লাগিয়ে দিলেন ৩ হাজার শিমুলের চারা। এভাবেই তৈরি হয় দেশের বড় শিমুল বাগান। প্রায় এক যুগ পর গাছগুলো অনেক বড় হয়ে উঠেছে। জয়নাল আবেদীন মারা যাওয়ার পর তার ছেলে বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রাখাব উদ্দিন এই বাগানের দেখাশোনা করেন।
বারেক টিলা
শিমুল বাগানের কাছেই আছে সুদৃশ্য বারেক টিলা। এই টিলায় বসে জাদুকাটা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় খুব সহজেই। আবার টিলার ওপর আছে কুরচি ফুলের বন। একসঙ্গে এত কুরচি গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। অবশ্য কুরচি গাছগুলো এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ কিংবা মহাখালী থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। চেয়ারকোচ ৩০০ টাকা আর এসি বাস ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা।
সুনামগঞ্চ ব্রিজে নেমে সেখান থেকে বাইকে অথবা সিএনজিসে লাউয়ারগড় যেতে হবে। বাইকে প্রতিজন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ও সিএনজি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা নেয়। তাই দামদর করে নিয়ে বাইক অথবা সিএসজিতে উঠবেন। লাউয়ারগড় বাজার থেকে জাদুকাটা নদী পার হলেই শিমুল বাগান।
শিমুল বাগান দেখা হলে হেটে বারেক টিলা যেতে পারেন। সময় লাগবে আধা ঘন্টার মতো।
ফেরার সময় বাইক বা সিএসজি সুনামগঞ্জ ব্রিজে নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে ১০ টাকা ভাড়ায় অটো বা ইজি বাইকে করে বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে।
মনে রাখবেন
শিমুল বাগানের আশেপাশে খাবারের দোকান নেই। তাই সাথে হালকা খাবার নিয়ে নিতে পানে। আর মনে রাখবেন, অপরুপ এই সৌন্দর্য আমাদের গর্ব। প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। তাই যেখানে সেখানে পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট বা অপচনশীল দ্রব্য ফেলবেন না। নির্ধারিত স্থানে ফেলবেন অথবা নিজের ব্যাগে করে নিয়ে এসে যথাযথ স্থানে ফেলবেন।