আমরা যারা গণিতের সাথে পরিচিত তারা অসীম বা ইনফিনিটি সম্পর্কে অবশ্যই শুনে এসেছি। ইনফিনিটি একটি কাল্পনিক ধারণা যা দ্বারা এমন কিছু বোঝানো হয় যার কোন সীমা নেই। যেমন ধরুন একটি বৃত্তের কথা। বৃত্তের চারপাশে আপনি কতবার চক্কর দিতে পারবেন? যতবার মন চায় ততোবার তাই না ! অর্থাৎ আমি বৃত্তের চারপাশে ঘোরার ব্যাপারটা কোন সীমার মাঝে আটকাতে পারবো না। কিন্তু বাস্তবে কি আসলেই আমরা ইনফিনিটির প্রয়োগ করতে পারি?
আধুনিক যুগে গণিতবিদরা ইনফিনিটিকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং গণিতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিসাবের সুবিধায় এটি ব্যবহার করছেন। তবে প্রাচীনকালে ইনফিনিটিকে মূলত দার্শনিক চিন্তাভাবনার মাঝে রাখা হতো। প্রাচীন গ্রীক এবং ভারতীয় গণিতবিদরা তাদের বিভিন্ন কাজে ইনফিনিটির ধারণাকে ব্যবহার করেছেন। প্রাচীনকালে ভারতীয় গণিতবিদরা সকল সংখ্যাকে ৩টি সেটে ভাগ করেছিলেন – গণনীয়, অগণনীয় এবং অসীম। ইউরোপিয়ান গণিতবিদরা মূলত নির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্য দিয়ে ইনফিনিটির ব্যবহার শুরু করেন। বিশেষ করে ক্যালকুলাসের আবিষ্কারের পরে হিসাবের সুবিধার জন্য ইনফিনিটির ব্যবহার জনপ্রিয়তা পায়।
ক্যালকুলাসের অন্যতম জনক লিবনিজ ইনফিনিটির ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। এছাড়া অসীমের সেট তত্ত্ব নিয়ে জর্জ ক্যান্টর বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন।
তবে বাস্তব জীবনে কি আসলেই ইনফিনিটির ব্যবহার দেখা যায়? এখানেই পদার্থ বিজ্ঞানের সাথে গণিতের সংঘর্ষ দেখা দেয়। পদার্থ বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, পরিমাপ করা যায় এমন কোন কিছুই অসীম হতে পারে না। যেমন ধরুন যদি অসীম মহাকর্ষীয় ভরের কোন বস্তুর অস্তিত্ব থাকতো, তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের সাহায্যে সেই বস্তুর মহাকর্ষীয় বল নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো কারণ ফলাফল সর্বদা অসীম হতো। তবে পদার্থবিজ্ঞানের কিছু ক্ষেত্রেও ইনফিনিটির ব্যবহার আছে, যেমন ব্ল্যাকহোলের সিঙ্গুলারিটি।
আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণ সমাধান করে আমরা জানতে পেরেছি যে ব্ল্যাকহোলে কোন স্থান দখল না করেই ভর থাকতে পারে, যার ফলে অসীম ঘনত্বের সৃষ্টি হয়। তবে সিঙ্গুলারিটি এমন একটি অবস্থা যেখানে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের সকল সূত্রের লঙ্ঘন হয়।
এমনকি অনেক গণিতবিদও ইনফিনিটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ইনফিনিটির বিরুদ্ধে অনেক গণিতবিদ যেসব তত্ত্ব দিয়েছেন সেগুলোকে বলা হয় ইনফিনিটিজম। ইনফিনিটির ধারণা যে আসলে বাস্তবসম্মত নয় তা বোঝানোর জন্য তৈরি হয় বিভিন্ন প্যারাডক্স যেমন – রাসেল’স প্যারাডক্স এবং বেরি’স প্যারাডক্স।
ইনফিনিটির বাস্তব ব্যবহার শুধুমাত্র গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ নয় বরং মহাকাশবিজ্ঞান সম্পর্কিত সৃষ্টি তত্ত্বের ব্যাখ্যায় ইনফিনিটি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া, মহাবিশ্বে তারার সংখ্যা ইনফিনিটি নাকি নয় তা নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণা চলছে। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর বিভিন্ন Logic স্থাপন করার জন্য ইনফিনিটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানী George Lakoff এর মতে, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে ইনফিনিটি একটি রূপক বা উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।