মনে করা যাক কোথাও একটা খুন হলো, লাশের পাশে মৃত ব্যক্তির রক্ত ছাড়াও অন্য কারও রক্ত বা শরীরের কোন অংশ যেমন চুল, নখ এমন কিছু পাওয়া গেলো এবং হতে পারে যে এটা খুনির। কিন্তু শুধু এটা দিয়ে কি কাউকে বের করা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। যে পরীক্ষার মাধ্যমে এই কাজটি করা হবে, তাকে ডিএনএ টেস্ট বলে।
প্রথমেই আমরা জেনে নেই, ডিএনএ ( DNA ) কি ? ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ একটি নিউক্লিক এসিড যা জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রনের জিনগত নির্দেশ ধারন করে। সকল জীবের ডিএনএ জিনোম থাকে। থাকে। জীববিজ্ঞানে কোন জীবের জিনোম বলতে সেটির সমস্ত বংশগতিক তথ্যের সমষ্টিকে বোঝায়, যা সেটির ডিএনএ তে সংকেতাবদ্ধ থাকে। একটি সম্ভাব্য ব্যতিক্রম হচ্ছে কিছু ভাইরাস গ্রুপ যাদের আরএনএ জিনোম রয়েছে, তবে ভাইরাসকে সাধারণত জীবন্ত প্রাণ হিসেবে ধরা হয় না। কোষে ডিএনএর প্রধান কাজ দীর্ঘকালের জন্য তথ্য সংরক্ষন। জিনোমকে কখনও নীলনকশার সাথে তুলনা করা হয় কারণ, এতে কোষের বিভিন্ন অংশে যেমনঃ প্রোটিন ও আরএনএ অণু গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী থাকে।
ডিএনএ বংশ গতির একক বা বাহক। এটি আমাদের জীবন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ডিএনএ অবস্থান করে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা ক্রোমোসোমে। দ্বি সুত্রক বিশিষ্ট এ পেঁচানো নিউক্লিক এসিড অণুটি মাস্টার মলিকিউল নামে পরিচিত। ডিএনএ এর গাঠনিক উপাদান হলোঃ ডি-অক্সিরাইবোজ সুগার, অজৈব ফসফেট ও অ্যাডেনিন (Adenine), গুয়ানিন ( Guanine), সাইটোসিন (Cytosine), থায়ামিন (Thymine) নামক নাইট্রোজেন বেস।
অর্থাৎ, মানুষের শরীরের মূল অংশ হচ্ছে ডিএনএ এবং এই ডিএনএ-ই প্রতিটি মানুষের বংশপরিচয় নিয়ন্ত্রণ করে। এক ফোঁটা রক্ত বা চুলের একটি অংশ থেকেও ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে আস্ত মানুষটির পরিচয় বের করা সম্ভব।
ডিএনএ টেস্ট কে নানা নামে অবহিত করা হয় যেমন- ডিএনএ প্রোফাইলিং, ডিএনএ টাইপিং, জেনেটিক ফিঙ্গার প্রিন্ট ইত্যাদি। একজন মানুষ এর সাথে আর একজন এর মানুষ এর ডিএনএ ৯৯.৯% মিল, বাকি দশমিক এক পারসেন্ট অমিলের জন্য মানুষে মানুষে এত বৈচিত্র্য। ডিএনএ টেস্ট প্রথম আবিষ্কার করেন ইংল্যান্ডের University of Leicester এর Sir Alec Jeffrey ১৯৮৪ সালে এবং বাণিজ্যিক ভাবে বাজারজাত করা হয় ১৯৮৭ সালে।
Sir Alec Jeffrey তার ল্যাব টেকনিশিয়ানের ফ্যামিলির সদস্যদের ডিএনএ, এক্সপেরিমেন্ট ডিএনএ হিসেবে ব্যবহার করে এ গবেষণা সম্পন্ন করেন। আবিস্কারের প্রথম দুই বছর Jeffrey এবং তাঁর টেকনিশিয়ানই শুধু ডিএনএ টেস্ট করতেন। ব্রিটেনে এক অভিবাসন মামলায়, ঘানার অভিবাসী পরিবারের এক বালকের পারিবারিক পরিচয় নির্ণয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় Sir Alec Jeffrey কে। ডিএনএ টেস্ট এর ফলাফলে দেখা যায় যে ওই বালকের ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ডিএনএ প্রোফাইলের মিল আছে, এবং ছেলেটি ব্রিটেন থেকে বিতাড়নের হাত থেকে রক্ষা পায়।
এরপর মানুষ লাইন ধরে Jeffrey র কাছে আসতে থাকে ডিএনএ টেস্ট করানোর জন্য। তখন Jeffrey চিন্তা করেন ডিএনএ টেস্ট বানিজ্যিকভাবে বাজারজাত করার। ডিএনএ টেস্ট আবিস্কারের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশ্বখ্যাত Newscientist ম্যাগাজিন Sir Alec Jeffrey কে 'Father of DNA Evidence' বলে অভিহিত করে।
ডিএনএ টেস্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের নমুনা ব্যবহার করা হয় যেমন-চুল, রক্ত, লালা ইত্যাদি । বিভিন্ন ধরণের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস যেমনঃ ট্রুথ ব্রাশ, রেজার ইত্যাদি এমনকি চর্বিত চুইংগাম থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে সেই টিস্যুও নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ডিএনএ টেস্টের পুরো প্রক্রিয়াটি যথেষ্টই জটিল।
ডিএনএ টেস্ট করার জন্য প্রথমে শরীরের যেকোনো টিস্যু নিয়ে সেটিকে এনজাইমের সাহায্যে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলো নাইট্রোসেলুলোজ বা নাইলন ফিল্টারে পাঠিয়ে জিনোম নির্ধারণ করা হয়। এ প্রক্রিয়াকে ' সাউদার্ন ব্লট ' বলে। এরপর এই জিনোম থেকে ডিএনএ প্রোফাইল বের করা হয় এবং এই প্রোফাইলকে Variable Number Tandem Repeat Sequence (VNTR) দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। ডিএনএ-তে লেখা থাকে আমাদের বিধিলিপি বা ভাগ্য। মাত্র চার অক্ষরে লেখা হয় এ বিধিলিপি বা ভাগ্য। জীববিজ্ঞানীরা A, T, G এবং C এ ই চারটি আদ্যক্ষর দ্বারা বিধিলিপির এ ভাষাকে প্রকাশ করেন। আদ্যক্ষর গুলো নেয়া হয়েছে নাইট্রোজেন বেসগুলোর আদ্যক্ষর থেকে। সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যখন মানুষ বিধিলিপি বা ভাগ্য জানার জন্য ভাগ্য গণনার জন্য গণকের কাছে না গিয়ে যাবে জীন বিজ্ঞানীদের কাছে! ভাগ্য সংক্রান্ত প্রচলিত কথাগুলিও তখন পরিবর্তন হয়ে যাবে। যেমন এখন আমরা বলি “ভাগ্যের লিখন যায় না খণ্ডন”, “এ লিখা ছিল আমার কপালে” অথবা “সবই আমার কপালের দোষ”। এক সময় হয়তো সবাই বলবে “ডিএনএ এর লিখন যায় না খণ্ডন”, “এ লিখা ছিল আমার ডিএনএ তে” অথবা “সবই আমার ডিএনএ এর দোষ”।