আমাদের বীরগাথা

ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-

বীরবিক্রম লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অব.) এস আই এম নূরুন্নবী খান মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই বীর সেনাদের একজন যিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করে শামিল হয়েছিলেন বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। মরহুম মওলানা হাবীবউল্লাহ মরহুমা শামসুন্নাহার বেগমের বড় ছেলে তিনি। নূরুন্নবী খানের জন্ম বৃহত্তর নোয়াখালী (বর্তমানে লক্ষ্মীপুর) জেলার রামগঞ্জ থানার লক্ষ্মীধরপাড়া গ্রামে।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমিশন র‌্যাংকের জন্য আবেদন করেন এবং সে বছরের নভেম্বরে আইএসএসবি দিয়ে চূড়ান্তভাবে কমিশন র‌্যাঙ্কের জন্য নির্বাচিত হন। আর্মি সিভিলিয়ান বৃত্তি নিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করেন ১৯৬৯ সালে। তারপর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে কমিশনপ্রাপ্ত হন ১৯৭০ সালে। সেখান থেকে তাকে কুমিল্লার ময়নামতিতে পোস্টিং দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে বেলুচিস্তানের কোয়েটায় তাকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কোয়েটা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তার নেতৃত্বাধীন তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপস বিভিন্ন যুদ্ধে অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। তিনি জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার তাকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে।

…………………………………………………………………………………..

'২ অক্টোবর ১৯৭১। এদিন আমার দল কোদালকাটির ওপরে মারাত্মক আক্রমণ চালালো। দুই কোম্পানি গেলো ফ্রন্ট অ্যাসল্টে। আর পেছনে যাদুরচরে ছিল আলফা কোম্পানি আর ফার্স্ট বেঙ্গল থেকে মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন আসা চার্লি কোম্পানি। তাদের এই মারাত্মক আক্রমণে পাকিস্তানিরা এদিন কোদালকাটির চর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় রৌমারী।

কিন্তু পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার সময় তাদের নির্মমতার চূড়ান্ত সাক্ষ্য রেখে যায়। ক্যাম্পে আটকে রাখা ৬৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে রশি বেঁধে মেরে রেখে যায়। এই লোকগুলোকে দিয়ে ওরা নিজেদের বিভিন্ন কাজ করাতো। এমনকি গ্রাম থেকে গরু-ছাগল ধরে এনে রান্না করতেও বাধ্য করতো।

এরপর অর্ডার আসলো, আমার দলকে চলে যেতে হবে সিলেটে। ৫ অক্টোবর আমাদের তেলঢালা ক্যাম্পে আসলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানী, ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা এবং জেনারেল মানেকশ।

তারা এসে অর্ডার করলেন, তিন ব্যাটালিয়ন নিয়ে পুরো ব্রিগেডকে ১০ অক্টোবর মুভ করতে হবে সিলেট। অর্ডার পেয়ে রৌমারী থেকে আমি আমার কোম্পানিকে নিয়ে এলাম। চলে আসার সময় ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের আমাকে অনুরোধ করলেন, ‘তুমি কিছু ট্রুপস এখানে রেখে যাও। পাকিস্তানিরা যদি আবার আক্রমণ করে তাহলে আমার সেক্টরের ট্রুপস দিয়ে ওদের আটকে রাখতে পারবো না।

ওরা তো আমাদের ট্রুপস থেকে অনেক বেশি কনভেনশনাল।’ তখন আবার আমার কোম্পানির সাথে এইট বেঙ্গলের লেফটেন্যান্ট মোদাচ্ছেরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিও ছিল। মেজর তাহেরের কথা মতো এই কোম্পানিটিকে ওখানে রেখে আমরা সিলেটের দিকে মুভ করি। সিলেটের যে অঞ্চলে আমাদের যাওয়ার অর্ডার হয় সেটা ছিল ৫নং সেক্টরের অধীনে।

সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল বাঁশতলায়। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। আমরা সবাই সড়কপথে গৌহাটি হয়ে শিলং পৌঁছাই। এরপর আমার থার্ড বেঙ্গলকে বলা হলো শেলা সাব- সেক্টরে যেতে।

শেলায় আমার দল ১১ অক্টোবর বিকালে পৌঁছালো। ১২ তারিখে সেখানে জেনারেল ওসমানী এবং মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল এলেন। আমাদের ১৪ তারিখ ছাতক অপারেশনে যাবার নির্দেশ দেয়া হলো। ছাতক থানা শহর হলেও এখানে বাণিজ্যিক নদীবন্দর ছিল। শহরটি তখনো প্রসিদ্ধ ছিল পাথরের ব্যবসার জন্য। হাদারটিলায় ছিল ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি।

এখানে পাকিস্তানিদের একটি ভালো প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। এখানে অপারেশনে যাওয়ার আগে কোনো ধরনের রেকি করার সুযোগ আমরা পাইনি। শুধু স্থানীয় গাইডদের দেয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করেই মেজর শাফায়াত জামিল সিদ্ধান্ত নিলেন মেইন অ্যাসল্টে যাবে আলফা কম্পানি এবং ব্রাভো কম্পানি। আলফা কম্পানির কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার আর ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর (পরবর্তীতে কর্নেল, মন্ত্রী, বর্তমানে পরলোকগত)।

ক্যাপ্টেন মোহসীনের চার্লি কোম্পানি কাট অফ পার্ট হিসেবে টেংরাটিলায় অবস্থান নেবে। এই কোম্পানিকে বলা হলো 'দোয়ারাবাজার থেকে ওয়াবদার বেড়িবাঁধ হয়ে অথবা নৌপথে যাতে পাকিস্তানি রিইনফোর্সমেন্ট এনে আমাদের পেছনে এসে অবস্থান না নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে। অন্যদিকে সিলেট থেকে যেন পাকিস্তানিদের কোনো রিইনফোর্সমেন্ট আসতে না পারে সেজন্য আমার কোম্পানি এবং ৫ নং সেক্টরের ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের একটা এফএফ কোম্পানি যাবে ছাতকের রিয়ারে।

এছাড়া ছাতকে থাকা পাকিস্তানিদের উইথড্রয়ালের রাস্তাও বন্ধ করতে হবে। একই সাথে ছাতক থেকে সিলেটের লামা কাজিঘাট পর্যন্ত যে কয়টি রেলওয়ে এবং সড়কপথের ব্রিজ-কালভার্ট আছে সেগুলোও আমাদের উড়িয়ে দিতে হবে। আর আমাদের রিয়ারের প্রোটেকশনে রিজার্ভ হিসেবে থাকবে রৌমারীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি স্টুডেন্ট কোম্পানি।

ওরা পজিশন নিলো পাকিস্তান বাজারে (বর্তমানে বাংলা বাজার)। রৌমারীতে আমি যেসব ছাত্র-জনতাকে দুদিনের ট্রেনিং দিতাম তাদের মধ্যে ছাত্রদের এই প্রথম ব্যাচটিকে আমি সিলেটে  নিয়ে আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র আফতাব ছিল এর কমান্ডার। ওর বাড়ি ছিল চিলমারীতে। এই কোম্পানিতে ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর এক ছেলে এবং শাহজাদপুরের এমএনএ মোতাহার মাস্টারের ছেলে।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমার দল মুভ করে প্রথমে গেলো ভোলাগঞ্জ। ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরের কমান্ডার সেকেন্ড লে. প্রকৌশলী আলমগীর (এনএএম আলমগীর। তিনি পিডব্লিউডির সিভিল ইঞ্জিনিয়ার)। তাদের সাথে আরো যোগ দিলেন কমান্ডার রশিদের এফএফ কোম্পানি, লেফটেন্যান্ট ইয়ামীন চৌধুরী (বীরবিক্রম) এবং লেফটেন্যান্ট ফখরুদ্দিন চৌধুরী (বীরপ্রতীক)-এর কোম্পানি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় অফিসারের সংখ্যা কম ছিল অন্যদিকে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর সময় ছিল না বলে এদের ফিল্ড কমিশন দিয়ে অফিসার করা হয়। এদের ছাতকের মুখে ‘লামনীগাঁ’ গ্রামে অবস্থান নিতে বললাম। বড়িডো বলে জায়গায় অবস্থান নিলেন লেফটেন্যান্ট ফখরুল। ভোলাগঞ্জ থেকে স্থানীয় গাইড নিয়ে ছাতকের পেছনে হাসনাবাদ এলাকায় রওনা হলাম।

ওখানকার রেলপথ ও সড়ক পথে আমাকে পজিশন নিয়ে সিলেটের দিকের যোগাযোগ ব্লক করে দিতে হবে। ওদিকে ক্যাপ্টেন মোহসীন কিন্তু টেংরাটিলায় পৌঁছার পরে নৌকা থেকে ওঠার আগেই ওখানে আগে থেকে অবস্থান করা পাকিস্তানিদের ফায়ারের মুখে পড়েন। এতে ক্যাপ্টেন মোহসীনের কোম্পানির ২৬ জন শহীদ হন। অনেকে আহত হন। বাকিরা নদীতে ডুবে ডুবে কোনো রকমে অপর পাড়ের গ্রামে এসে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন।

ক্যাপ্টেন মোহসীনও গুলিতে আহত হন। তাদের স্থানীয় কবিরাজরা প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। পরে তিনি বাঁশতলায় ফিরে আসেন। তার পুরা কোম্পানির অস্ত্র সুরমা নদীতে পড়ে গিয়েছিল। হাওর এলাকায় দিকনির্দেশনা বুঝতে পারা বেশ কঠিন। ক্যাপ্টেন নূরুন্নবীর কোম্পানি স্থানীয় গাইডের কথা মতো আর ছাতকের বাতি দেখে দেখে হাওরে দিক ঠিক রেখে মোটামুটি জায়গা মতোই পৌঁছে যায়।

কিন্তু তার কোম্পানির ১০নং প্লাটুনের (সুবেদার করম আলীর প্লাটুন) গাইড ঠিক মতো দিকনির্দেশনা করতে না পারায় ওরা গিয়ে পৌঁছে অন্য এক গ্রামে। কমান্ডার রশিদের পুরো কোম্পানিও একই ভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়। ওদের ওপর দায়িত্ব ছিল ব্রিজ ও কালভার্টগুলো উড়িয়ে দিয়ে  গোবিন্দগঞ্জ এবং লামাকাজি ঘাট দিয়ে অবস্থান নেয়া। সময় মতো তারা অপারেশনে আসতে না পারায় ক্যাপ্টেন নূরুন্নবীর দল আর এসব ব্লক করতে পারেননি।

পরে ট্রুপস যা পেলাম তা নিয়েই আমি পজিশন নেই। আমার মেশিনগানের পজিশন ছিল নদীর পারে বোবড়া গ্রামের একটি মসজিদ এলাকায়। এই জায়গাটা একটু উঁচু ছিল। শাফায়াত জামিল স্যার সব সময়ই আমাকে যুদ্ধের নানা কৌশল শেখাতেন। তার শেখানো কৌশল অনুযায়ী মর্টার, আরআর, আর্টিলারি গানের পজিশন বসাই। পাকিস্তানিরা ছিল সামনের খোলা মাঠের অপর প্রান্তে।

আমার সামনে পুরো ফিল্ড অফ ফায়ার ছিল ক্লিয়ার। পাকিস্তানিরা বারবার অ্যাটাক করার জন্য আসছিল আর আমার মেশিনগানের রেঞ্জের মধ্যে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ওরা তো কনভেনশনাল আর্মি। আমরাও বুঝতে পারছিলাম ওরা সহজে পিছু হটবে না। ঠিক সেটাই দেখলাম, ওরা দলে দলে আসছিল আর মারা যাচ্ছিল। যেন মৃত্যুর খেলা চলছিল। এভাবে সারা দিন ধরে যুদ্ধ চললো।

সন্ধ্যার দিকে দেখলাম, ওদের রিইনফোর্সমেন্ট চলে এসেছে। আমাদের ব্যাটালিয়ন পজিশনকে লক্ষ্য রেখে ওরা খুব সতর্ক হয়ে আস্তে আস্তে এগুচ্ছিল রেললাইন এবং রোডের কভার নিয়ে। যখন দেখলাম ওরা আমাদের থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে চলে এসেছে তখন সব ট্রুপসকে সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে পাঠিয়ে দিতে শুরু করলাম।

আমি, সাব-সেক্টর কমান্ডার আলমগীর, আমাদের নৌকার মাঝি-গাইড আজাদ মিয়া সব শেষে যাবো বলে রয়ে গেলাম। নৌকার মাঝি এসহাক আলীকে যখন পাঠালাম সুবেদার আলী আকবরের  শেষ সেকশনটিকে উইথড্র করে নৌকায় ওপর পাড়ে পৌঁছে দিতে তখন পাকিস্তানিরা আমাদের প্রায় ঘেরাও করে ফেলেছে। এমন অবস্থায় সুবেদার এসহাক আলীও আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকা এই পাড়ে আনতে পারছিল না। আমরা তখন একটি গাছের আড়ালে গিয়ে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম।

আলমগীরকে বলে দিলাম, ‘আমি আমার মেশিনগান প্রস্তুত রেখেছি, তুমিও তোমারটা প্রস্তুত রাখো। যখন দেখবে আমরা দুজনই ধরা পড়ে যাচ্ছি, তখন কিন্তু আমরা ধরা দেবো না। শেষ গ্রেনেডটা ওদের দিকে থ্রো করে আমরা দুজন দুজনকে গুলি করে শহীদ হয়ে যাবো।’ আমরা যখন এই পজিশনে চলে এসেছি ঠিক ওই মুহূর্তে হঠাৎ দেখি, স্ত্রী ও ছোট একটি বাচ্চাকে সাথে নিয়ে এক লোক নৌকায় করে সুরমা নদীর এই পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছেন।

এই নৌকা দেখতে পেরে আমাদের মাঝি ও গাইড আজাদ মিয়া লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে টেনে নৌকাটা পাড়ে নিয়ে এসেই বলে, ‘স্যার, নৌকায় ওঠেন’। আমাদের দুজনকেই নৌকায় তুলে দিয়ে পাটাতনে শুয়ে পড়তে বললো। আর আজাদ মিয়া করেছে কি! অভিজ্ঞ মাঝি তো! নৌকায় বাড়তি লগি ছিল ওটা দিয়ে জোরে ধাক্কা মেরেছে নৌকা। এক ধাক্কাতেই নৌকা প্রায় মাঝ নদীতে চলে গেছে।

পাকিস্তানিরাও আমাদের নৌকা লক্ষ্য করে গুলি করছে। গুলিতে নৌকা যায় ফুটো হয়ে। নৌকায় উঠতে থাকে পানি। লেফটেন্যান্ট আলমগীরের পরনে যে গেঞ্জিটা ছিল ওটা আগে থেকেই ছেঁড়া ছিল। আলমগীর গেঞ্জির ওই ছেঁড়া জায়গাটা ধরে টান দিয়ে আরো ছিঁড়ে ফেলে তা দিয়ে নৌকার ফুটোয় চাপ দিয়ে বন্ধ করে রাখে। পাকিস্তানিরা তো সমানে গোলাগুলি ছুড়ছে।

তার মধ্যেই মাঝিরা নৌকা নদীর এক বাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। নদীর অপর পাড়ে আমরা নেমে গিয়ে ক্রলিং করে একটি ঘরের আড়ালে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। এখানে আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। ছাতকের পেছনে একটি লোহার ব্রিজের পাড়েই কালারুখা গ্রাম। এই গ্রামের লোকদের কাছে পরে জেনেছি, এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।'

সিলেট অঞ্চলের ডাউকি এলাকার ছোটখেল ও রাধানগর অপারেশনে ক্যাপ্টেন (তৎকালীন) এস আই এম নূরুন্নবী খানের নেতৃত্বাধীন তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপস অসামান্য সাফল্য অর্জন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে যৌথবাহিনীর কমান্ড চ্যানেল ভঙ্গ করে ক্যাপ্টেন নূরুন্নবী খানকে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে সে এলাকার সব ধরনের অপারেশনের ‘অপারেশনাল কমান্ডার’ এর দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়।

১ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ দেয়া এই নির্দেশের পর থেকেই মিত্রবাহিনীর ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট, ২৫ আসাম রেজিমেন্ট, স্থানীয় ডাউকি সেক্টরের বিএসএফের সবগুলো ইউনিট ক্যাপ্টেন নূরুন্নবী খানের কমান্ডে চলে আসে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর কোনো অফিসার কর্তৃক যৌথবাহিনীকে কমান্ড করার এটিই হচ্ছে একমাত্র ঘটনা। এই অর্ডারটি সমগ্র বাঙালি জাতির শৌর্যের প্রতীক। একই সাথে এটি তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।

যুদ্ধ বরাবরই ভয়াবহ, রক্তক্ষয়ী। শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে গেলে প্রয়োজন হয় দুর্ধর্ষ এবং বিচিত্র ও অভিনব সব রণকৌশল। যুদ্ধের বীভৎসতা সব সময়ই অমানবিক। সিলেটের গোয়াইনঘাটের আনকনভেশনাল যুদ্ধে এমনি অমানবিকতা আর বীভৎসতা দেখেছেন লে. কর্নেল (অব.) এস আই এম নূরুন্নবী।  ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভোর রাতে গোয়াইনঘাটের সেই অপারেশনটিতে আক্রমণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এস আই এম নুরুন্নবী খান, বীরবিক্রম।

‘রাতের বেলায় কোনো নৌকাই সুরমা নদীর পশ্চিম পাড়ে থাকতে পারতো না। নৌকা তো সব অন্য পাড়ে। নদীতে নৌকা চলাচলও পাকিস্তানিরা নিষিদ্ধ করেছিল। আমরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে পাটের গাঁট সংগ্রহ করে কুর্ণি গ্রামে বসে অনেক লম্বা-মোটা রশি বানাই। ভারতীয় মেজর ওয়াই পি সিং জিজ্ঞেস করছিল ‘এতো রশি কী জন্য!’ আমি বলছিলাম ‘গোয়াইনঘাট অপারেশনে এক খেলা দেখবে!’

আমার ট্রুপস পশ্চিম পাড়ে ফায়ারিং পজিশন নেয় কাভারিং ফায়ার দেয়ার জন্য। প্রত্যেক প্লাটুনের জন্য স্থানীয় ৮/১০ জন করে গাইড দেয়া হয়েছিল। এদের কাজ ছিল, রাইট ফ্ল্যাঙ্ক থেকে আলফা ও লেফটেন্যান্ট ইয়ামীনের কোম্পানি বুলেট নিক্ষেপের সাথে সাথে ফায়ার কভারের সুযোগে নির্দিষ্ট গাইডরা নৌকা টেনে আনার জন্য নদীতে নেমে পড়বে। এদের প্রত্যেকের হাতেই ৩০০ থেকে ৩৫০ গজ লম্বা দুটি করে মাঝারি ধরনের মোটা পাটের রশি থাকবে। একটি রশির মাথা পশ্চিম পাড়ে ছোট একটি খুঁটির সাথে গেঁথে রেখে যাবে।

রশির অপর প্রান্তটি নৌকার একটি গলুইয়ের সাথে বেঁধে দেবে। অন্য রশিটি নৌকার অপর গলুইতে বেঁধে এরা নদীর পূর্বপাড়েই আড়ালে অবস্থান নিয়ে থাকবে। আমার অবস্থান থেকে গ্রিন ওভার রেড স্ট্রেচার বুলেট নিক্ষেপের সাথে সাথেই পশ্চিমপাড়ে অবস্থানকারী গাইডরা সজোরে টান দিয়ে নিমিষেই নৌকাগুলোকে পশ্চিমপাড়ে নিয়ে আসবে। ঠিক একইভাবে সৈনিকদের নৌকায় ওঠার পরপরই পূর্বপাড়ে অবস্থানকারী গাইডরা সজোরে ভিন্ন রশিটি টেনে নিমিষেই নৌকাগুলোকে অপর পাড়ে নিয়ে ভেড়াবে।

পূর্বপাড়ে নৌকা ভেড়া মাত্রই আমাদের সৈন্যরা দ্রুততার সাথে পাড়ের আড়ালে অবস্থান নিয়ে নেবে। এক কোম্পানি সৈন্যকে অপর পাড়ে আনার জন্য যে কয়টা নৌকার প্রয়োজন ছিল সে কয়টা নৌকাই সেখানে ছিল।

ফলে নিমিষের মধ্যে পুরো এক কোম্পানি সৈন্য নদীর অপর পাড়ে চলে এলো। প্লাটুন ও সেকশন অনুযায়ী লোকজন উঠে গেলো। ডিসেম্বর মাস হবার কারণে নদীর পাড় ছিল পানির স্তর থেকে কমপক্ষে ১২/১৪ ফুট উঁচু। এজন্য পরিকল্পনা করেছিলাম, আমার ট্রুপস ৪৫ থেকে ৬০ ডিগ্রি কোণ ঢালুতে নদীর পাড় ঘেঁষে অবস্থান নিয়ে নিতে পারলে শত্রুর পক্ষে কোনোভাবেই আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করা সম্ভব হবে না।

পরিকল্পনামাফিক সৈন্যরা একসাথে ওই পাড়ে গিয়েই গ্রেনেড থ্রো করতে করতে ওপারে উঠে যায়। পাকিস্তানিরা আর কী যুদ্ধ করবে! ওরা ট্রাক, জিপ, পিকআপে ওঠারও চিন্তা করেনি।  তারা  তখন জীবন বাঁচাতে  গ্রামের কোনাকুনি পথে ফসলের ক্ষেত দিয়ে দৌড়ে খাদিমনগরের উদ্দেশে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায়  সকাল ৮টার আগেই আমি গোয়াইনঘাট দখল করে ফেলি।

এরপর কর্নেল রাজসিংকে গোয়াইনঘাট দখলের কথা জানালাম। তিনি তা শুনে খুবই অবাক হয়ে বললেন, ''What is that! You are supposed to go for the attack tomorrow'. আমি বললাম 'Yes ! I have changed plan and captured it today'. আমি আরো বললাম ‘একদিন আগেই আমি ওটা দখল করে নিয়েছি। অবশ্যই এটা ভালো খবর’। তিনিও বললেন ‘হ্যাঁ, অবশ্যই এটা ভালো খবর। আমরা তোমাদের দেখতে আসছি।’

(সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত)

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন