লুডু খেলার সাথে সবাই পরিচিত। ঘরে বসে সবাইকে নিয়ে এই মজার খেলা খেলতে হলে দরকার একটা লুডু কোর্ট আর একটা ডাইস। এই ডাইস ফেলেই খেলতে হয় লুডু। কিন্তু ডাইসে ছক্কা উঠবে নাকি দুই উঠবে তা বোঝার উপায় কি? খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, এটা আগে থেকে জানা অসম্ভব যে ডাইসে কোন দান উঠবে। আগেরজনের দানে কি উঠেছিল তার সাথে আপনার কি উঠবে এর কোনই সম্পর্ক নেই ! পৃথিবীতে এমন অসংখ্য ক্ষেত্র আছে যেখানে এই লুডুর ডাইসের মতই আগে থেকে কিছু বোঝা যায় না যে ফলাফল কি হতে চলেছে। তবে তারপরেও মানুষের কৌতূহল থেমে থাকেনি। বিজ্ঞানীরা এসব ঘটনার ফলাফল নিয়েও তাই গবেষণা করে চলেছেন।
যে সকল ঘটনার মাঝে কোন প্যাটার্ন থাকে না এবং যেসব ঘটনা আগে থেকেই অনুমান ( Predict ) করা যায় না তাদেরকে বলা হয় র্যানডম ইভেন্ট। র্যানডম ঘটনা কোন অর্ডার অনুসরণ করে না। এদের মাঝে কোন প্রকার ধারাবাহিকতাও নেই। যার ফলে এর ফলাফল আগে থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায় না। র্যানডম ঘটনা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। একটি কয়েন উপরে ছুঁড়লে হেড উঠবে নাকি টেল উঠবে এর ফলাফলও আমরা জানি না। তাই এটিও একটি র্যানডম ঘটনা।
তবে এটি র্যানডম দেখেই বিজ্ঞানীরা একে ছেঁড়ে দিবে এমনটা হয় না ! তাই তো তারা কোমর বেঁধে নেমেছেন র্যানডম ঘটনার মাঝেও কোন ফলাফলের সম্ভাবনা বেশি তা বের করতে। আর এসব গবেষণা করে তারা বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য বের করতে পেরেছেন। যেমন কোন র্যানডম ঘটনার ফলাফল নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও যদি বহুবার সেই ঘটনা ঘটানো হয় তাহলে এর সম্ভাব্য প্রতিটি ফলাফল প্রায় সমান সংখ্যকবার পাওয়া যাবে।
কয়েনের কথা ধরা যাক। কয়েন উপরে ছুঁড়ে মারলে এর দুটি সম্ভাবনা আছে – হয় হেড না হয় টেল। যদি উপরে ছুঁড়ে দেওয়ার সংখ্যাটা বেশ বড় করা হয় যেমন ধরুন যদি হাজারবার একটি কয়েন উপরে ছোঁড়া হয়, তাহলে এর হেড আর টেল ওঠার সংখ্যা হবে প্রায় সমান। অর্থাৎ, দুইটাই ৫০০ এর খুব কাছে থাকবে। আবার ডাইসের কথাই ধরুন। একসাথে যদি দুইটা ডাইস ৪ বার চালা হয় তাহলে দুইবার এই দুটি ডাইসের সংখ্যার যোগফল হবে ৭ এর সমান। অর্থাৎ র্যানডমনেস দিয়ে বৃহৎ পরিসরে আমরা কোন ঘটনার সম্ভাব্য ফলাফল হিসাব করি।
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ র্যানডমনেস এর সাথে পরিচিত। তবে আগের যুগে মানুষ একে শুধুই ভাগ্য পরীক্ষার উপায় হিসাবে দেখতো। তখন অনেকেই কয়েন ছুঁড়ে দেখতেন তার ভাগ্য আজকে কেমন। এভাবে শুরু হয় ভাগ্যের বিভিন্ন খেলা যেমন জুয়া। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে মানুষ এইসব র্যানডম ঘটনার মাঝেও ফলাফলের সম্ভাব্যতা বের করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ক্যালকুলাসের আবিষ্কারের পর র্যানডমনেস এর ফলাফলের সম্ভাব্যতা বের করার আরও নিখুঁত উপায় বের হয়।
কেন বিজ্ঞানীরা র্যানডমনেস নিয়ে গবেষণা করছেন? কারণ জগতের অনেক কিছুই আমাদের জন্য র্যানডম। যেমন, ধরা যাক কোন তরল বা গ্যাসের মধ্যে একটি অণুর গতিপথ। একটি অণু এলোমেলো পথে ঘুরতে থাকে এই ক্ষেত্রে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাপগতিবিদ্যা (Thermodynamics) ও পরিসংখ্যানবিদ্যার ( Statistical Mechanics) অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা হয়েছে অণুসমূহের র্যানডম বা এলোমেলো গতিপথের চরিত্র দ্বারা।
এমনকি আধুনিক কোয়ান্টাম ফিজিক্সেও বলা হয়েছে যে মাইক্রোস্কোপিক ঘটনাগুলো বস্তুর সাপেক্ষে র্যানডম। ম্যাথমেটিক্সেও র্যানডমনেস নিয়ে গবেষণা করা হয়। কোন ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা ( Probability) যাচাইয়ে আমরা র্যানডমনেসের মুখোমুখি হই। এখানেই থেমে নেই এর ব্যবহার। র্যানডমনেসকে গুরুত্ব ও প্রয়োগ করা হয়েছে ইনফরমেশন সাইন্স, অর্থনীতি এমনকি রাজনীতির বিভিন্ন থিওরিতেও। এছাড়া, উৎপাদন শিল্পে উৎপাদিত দ্রব্যের গুনাগুণ বাছাইয়ে র্যানডমনেসের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া, গোয়েন্দা বা কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা এয়ারপোর্ট বা নৌ-বন্দরে র্যানডমভাবে বস্তু বা ব্যাগ পরীক্ষা করে থাকেন।
আর আমরা ? হ্যাঁ, সাধারন মানুষরাও র্যানডমনেসকে দৈনন্দিন জীবনের সাথী করে নিয়েছে। বিভিন্ন গেমস এ যেমন বাজি ধরা কিংবা লটারিতে আমরা র্যানডমনেসকে ব্যবহার করছি। লটারির বিজয়ী নির্ধারণ করাতেও এটি ব্যবহৃত হয়। ক্রিকেট, ফুটবলের মত অনেক স্পোর্টসে খেলা শুরুর আগে কয়েন টস হয়, এটিও র্যানডমনেসের ব্যবহার।
র্যানডমনেস সম্ভাব্যতার সাথে জড়িত। যত নতুন তথ্য যোগ হবে র্যানডমনেস তত পরিবর্তিত হবে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটা গেম খেলা যাক। মনে করি একজন মহিলার দুটো সন্তান আছে। তাকে প্রশ্ন করা হলো যে আপনার দুই সন্তানের মাঝে কি কোন মেয়ে আছে? সেই মহিলা বললেন হ্যাঁ। এখন আপনার কাছে প্রশ্ন হলো যে, সেই মহিলার অপর সন্তানটিও মেয়ে হবার সম্ভাব্যতা কত?
ভেবে উত্তর দিন তো। বেশিরভাগ মানুষই বলবেন যে অপর সন্তানটি মেয়ে হবার সম্ভাব্যতা ৫০% ( ১/২ ভাগ ) কারণ সেই সন্তানটি ছেলে বা মেয়ে যেকোনো একটি হতে পারে। কিন্তু উপরের সকল তথ্য যাচাইয়ের পর দেখা যাবে যে, আসলে তার অপর সন্তানটিও মেয়ে হবার সম্ভাব্যতা আসলে ৩৩% ( ১/৩ ভাগ )। এমনটা কিভাবে হলো? কারণ, উপরে মহিলার তথ্য অনুযায়ী তার একটি সন্তান মেয়ে। এখন আমরা যেকোনো মানুষের ২টি সন্তানের মাঝে কয়টি ছেলে বা মেয়ে থাকবে তার একটি লিস্ট বানালে সেটি হবে এইরকম – ছেলে/মেয়ে, ছেলে/ছেলে, মেয়ে/ছেলে, মেয়ে/মেয়ে। অর্থাৎ, কারো দুইটি সন্তান থাকলে তাদের সন্তান এই চারটি ভাগের মাঝে কোন একটিতে পড়বে। কিন্তু আমাদের ধাঁধার মহিলা বলেছেন যে তার কমপক্ষে একটি মেয়ে আছে তাই এই চারটি ভাগ থেকে ছেলে/ছেলে ভাগটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ছেলে/ছেলে ভাগে কোন মেয়ে নেই কিন্তু মহিলার কমপক্ষে একটি মেয়ে রয়েছে তাই এই ভাগটি আর সম্ভাবনা হিসাবে থাকছে না। তাই অপর সন্তান মেয়ে হওয়ার সম্ভাব্যতা আসলে ১/৩ ভাগ, ২/৪ ভাগ নয়।