আর কিছুদিন পরেই শুরু বর্ষাকাল। তবে গত বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের সব জায়গাতেই চলছে কমবেশি বৃষ্টি। সময়ে-অসময়ে সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছে মেঘ, কখনো এক পশলা কখনো বা মুষলধারে হচ্ছে বৃষ্টি। আর এমন মেঘলা দিনগুলোতেই গুনগুন করে মন গেয়ে উঠে, “এই মেঘলা দিনে একেলা ঘরে থাকে না তো মন।”
মন তো ঘরে থাকতে চায় না। কিন্তু এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে যাবেনই বা কোথায়! বেশিরভাগ মানুষের মতেই বর্ষাকাল ঘুরতে যাওয়ার জন্য একদম অনুপযোগী একটা সময়। অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি আর কাঁদা-পানির ঝঞ্ঝাটে ভ্রমণটাই যেন মাটি হয়ে যায়। তাদের মতে শীতকালই ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময়। এসময় থাকেনা সূর্যের তালু ফাটানো রোদ আর গরমে ঘেমে নেয়ে যাবার বিরক্তি, থাকেনা অকস্মাৎ বা মুষলধারে বৃষ্টির দুশ্চিন্তাও।
অথচ বর্ষাকাল কিন্তু ঘুরতে যাবার একটা দারুণ সময়। ঝর্ণা বা জলপ্রপাত দেখার সেরা সময় এটি। বর্ষার বৃষ্টিতে ঝর্ণাগুলো তাদের প্রকৃত রূপ ধারণ করে। এমনিতে যেসব ঝর্ণায় সারা বছর পানি থাকে সেগুলো বর্ষায় ফুলে ফেঁপে উঠে। আর অন্য সময় যেগুলো মরা থাকে বর্ষা আসলে সেসব ঝর্ণার মধ্যে আবারও প্রাণের সঞ্চার হয়। সেই সাথে পানির স্রোতে সৃষ্টি হয় সাময়িক অনেক ঝর্ণা।
আমাদের দেশে নায়াগ্রা জলপ্রপাত, ভিক্টোরিয়া বা এঞ্জেল জলপ্রপাতের মতো সুবিশাল আর বিশ্বখ্যাত জলপ্রপাত হয়তো নেই। কিন্তু আমাদের দেশেও অসাধারণ কিছু চোখ জুড়ানো ঝর্ণা রয়েছে। বৃষ্টির সময় গেলে আপনি হয়তো সেগুলোর পূর্ণ রূপ-যৌবন উপভোগ করতে পারবেন। এমনি কয়েকটি ঝর্ণার খবরাখবর জানাবো আজকে।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত
দেশের উত্তরপূর্ব দিকে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত বলে স্বীকৃত। প্রায় ৮৩ মিটার উচু পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশি অবিরাম ধারায় নিচে পড়ছে। বিরামহীন এই জলরাশি পতনের ফলে সৃষ্ট কুন্ডের প্রবাহ যেন এক শান্তির বারিধারা। এই জলপ্রপাতকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক যার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। এছাড়া কাছেই পরীকুন্ড জলপ্রপাত নামে আরেকটি জলপ্রপাতও রয়েছে এখানে।
মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং সিলেট জেলা থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। ঢাকা, সিলেট বা দেশের যেকোনো জায়গা থেকে বাসে বা ট্রেনে সহজেই মাধবকুণ্ড যাওয়া যায়। ট্রেনে গেলে নামতে হবে কুলাউরা স্টেশন। সেখান থেকে বাস বা সিএনজি করে যাওয়া যাবে মাধবকুণ্ড। থাকার জন্য এখানে জেলা পরিষদের ২টি বাংলো এবং ২টি আবাসিক হোটেল রয়েছে।
হিমছড়ি জলপ্রপাত
পৃথিবীর দীর্ঘতম সী-বিচের জন্য বিখ্যাত কক্সবাজার। কিন্তু এই কক্সবাজারেই রয়েছে প্রকৃতির আরেক সৌন্দর্য হিমছড়ি জলপ্রপাত। সমুদ্রের ঠিক বিপরীতেই পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা এই জলপ্রপাত আপনাকে দেবে এক নতুন মুগ্ধতা, সৌন্দর্যের এক নতুন সংজ্ঞা। বর্ষাকালে এই জলপ্রপাতে পানি গর্জন করে। এসময় গেলে দেখতে পারবেন এর আসল সৌন্দর্য।
কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ রোড হয়ে ইনানি যাবার পথেই পড়ে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান ও হিমছড়ি জলপ্রপাত। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার আর কলাতলী বীচ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জলপ্রপাত। সিএনজি, অটোরিকশা বা ব্যক্তিগত পরিবহনে সহজেই এখানে পৌঁছানো যায়। তবে এখানে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। থাকতে হবে কক্সবাজারের কোন হোটেলে।
পান্থুমাই ঝর্ণা
সিলেট জেলার অসংখ্য সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম এই পান্থুমাই ঝর্ণা। বর্ষাকালে এই ঝর্ণার দেখে চোখ সরাতে পারবেন না। তবে কষ্টের কথা হচ্ছে আপনাকে ঝর্ণাটি দূর থেকেই দেখতে হবে। কেননা পান্থুমাই ঝর্ণাটি পড়েছে মূলত ভারতের সীমানার মধ্যে। তবে এর স্রোতধারা বয়ে গেছে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে। দুদেশের মাঝখানে রয়েছে একটা সরু খাল আর ওপারে বিএসএফের ক্যাম্প। তবে ভারতে পড়লেও পান্থুমাইয়ের সৌন্দর্য বাংলাদেশ থেকেই বেশি উপভোগ করা যায়। অনেকটা ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের মতো। বর্ষাকালে সিলেট থেকে জাফলং যাবার সময় ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর গা বেয়ে অনেক ঝর্ণা দেখা যায় যেগুলোর সৌন্দর্য বাংলাদেশ থেকেই বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
পান্থুমাই ঝর্ণা দেখতে হলে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে সিলেট। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে যেতে হবে হাদারপাড় বাজার। বাজারের ঘাট থেকে ইঞ্জিনের নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় যেগুলোতে করে আরামসে ঘুরে আসতে পারবেন পান্থুমাই। বোনাস হিসেবে বিছানাকান্দি আর লক্ষণছড়াও ঘুরে আসতে পারেন।
রিসাং ঝর্ণা
খাগড়াছড়ির এক অনন্য সৌন্দর্য রিসাং ঝর্ণা। মারমা ভাষায় ‘রি’ শব্দের অর্থ পানি আর ‘ছাং’ শব্দের অর্থ গড়িয়ে পড়া। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে আলুটিলা পেরিয়ে সামান্য পশ্চিমে মূল রাস্তা থেকে উত্তরে ঝর্ণার দূরত্ব প্রায় ১১কিঃ মিঃ। রিসাং ঝর্ণায় যাওয়ার পুরো রাস্তাটাই রোমাঞ্চে ভরপুর। রাস্তায় পড়বে উঁচু-নীচু সবুজ পাহাড়, বুনোঝোঁপ আর নাম না জানা রঙ্গীন বুনোফুলের নয়নাভিরাম অফুরন্ত সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্য যে কাউকে নিয়ে যাবে এক কল্পনার রাজ্যে।
রিসাং ঝর্ণা খুব বড় নয় বা খুব উঁচুও নয়। বড়জোর ৩০-৩৫ ফুট উঁচু এই ঝর্ণা। তবে বর্ষার সিজনে এখানে প্রচুর পানি থাকে। ঝর্ণার কাছে গেলে এক পবিত্র স্নিগ্ধতায় দেহমন ভরে উঠে। কিন্তু রিসাং ঝর্ণার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসটি হচ্ছে এর পানি গড়িয়ে পড়ার রাস্তা। পাথরের উপর ঝর্ণার পানি পড়ে গড়িয়ে গিয়ে রাস্তাটিকে করে তুলেছে পিচ্ছিল। আর এই পিচ্ছিল জায়গায় স্লাইড করে নিচের পানিতে গিয়ে পড়ার এক দুর্দান্ত মজা আছে। অনেকটা নন্দন বা ওয়াটার কিংডমের ওয়াটার রাইডগুলোর মত। তবে এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটার সম্ভাবনা আছে। তাই স্লাইডিং করার সময় যথেষ্ট সাবধান থাকতে হবে।
খাগড়াছড়ি সদর থেকে কম মানুষ হলে সিএনজি আর বেশি মানুষ থাকলে চাঁদের গাড়ি নিয়ে রিসাং ঝর্ণায় যাওয়া যায়। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নামার পর ১০-১৫ মিনিট পায়ে হাঁটলেই পাওয়া যাবে ঝর্ণার দেখা। আর রাতে থাকতে হবে খাগড়াছড়ি শহরেই।
ছবিঃ সংগৃহীত