আজ সোমবার বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটা সাত মিনিট। ভূকম্পনে কেঁপে উঠে বাংলাদেশ। উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর রাজ্যের ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকা। উৎপত্তিস্থলে ভূকম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬.৭। আজ আমরা জানবো ভূমিকম্প কেন হয় ও ভূমিকম্পের সময় আমাদের কি করা উচিত এই সম্পর্কে।
পৃথিবীর কঠিন ভূত্বকের কোনো কোনো অংশ প্রাকৃতিক কারণে কখনো কখনো অল্প সময়ের জন্য হটাৎ করে কেঁপে ওঠে। ভূত্বকের এই আকস্মিক কম্পনকে ভূমিকম্প বলা হয়। ভূকম্পন সাধারণত কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয় আবার কখনো কিছু সময় পরপর অনুভূত হয়।
জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রের্ড ওয়েগনারের কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট ( Continental Drift ) তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর উপরিতল কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলোকে বলা হয় টেকটনিক প্লেট। একেকটি টেকটনিক প্লেট মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গলিত পদার্থের বাহিরের আবরণ যা একটি পাথরের স্তর। ভূ-স্তরে যা কিছু রয়েছে তা এই প্লেটগুলোর উপরে অবস্থিত।
টেকটনিক প্লেটগুলো একে অপরের সাথে পাশাপাশি লেগে রয়েছে। এগুলো প্রায়ই নিজেদের মাঝে ধাক্কায় জড়িয়ে পড়ে। কখনও মৃদু আবার কখনও সজোরে। যেহেতু প্লেটগুলো শিলা দ্বারা গঠিত, তাই ধাক্কার ফলে তাদের মাঝে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের মাত্রা অধিক হলে এক ধরনের শক্তি নির্গত হয় যা ভূ-স্তরকে প্রকম্পিত করে। যদিও ভূমিকম্পের আরও কারণ রয়েছে তবে এই কারণটিই অধিকাংশ ভূমিকম্পের জন্যে দায়ী।
স্থলভাগের যে বিন্দুতে ভূমিকম্পের তরঙ্গ সূচিত হয় তাকে কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে স্পন্দন সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম এটি কেন্দ্রের ঠিক ওপরের বিন্দু বরাবর ভূপৃষ্ঠে অনুভূত হয় যাকে উপকেন্দ্র (Epicentre) বলে। এই উপকেন্দ্রেই ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকি অনুভূত হয়। কেন্দ্রের গভীরতার ভিত্তিতে ভূমিকম্পকে অগভীর কেন্দ্র (০-৭০ কিলোমিটার), মাঝারি কেন্দ্র (৭০-৩০০ কিলোমিটার) ও গভীর কেন্দ্র (৩০০ কিলোমিটার) ইত্যাদি সংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়।
ভূমিকম্প প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত হচ্ছে। তবে এর মাত্রা রিখটার স্কেলে ৩ এর উপরে উঠলে আমরা টের পায়। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিনই ভূপৃষ্ঠের ভেতরে কোথাও না কোথাও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হচ্ছে৷ তবে সবগুলো অত জোরালো নয়৷ ভূমিকম্পের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে জমে থাকা শক্তি নির্গত হয়৷ এই শক্তিকে মাপা হয় রিখটার স্কেলের মাধ্যমে৷ সাধারণত ভূমিকম্পকে ১ থেকে ১২ মাত্রা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়৷ ৩ থেকে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প বোঝা গেলেও ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় না৷ তবে ৫ কিংবা ৬ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেই সেগুলোকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়৷ রিখটার স্কেলের এক মাত্রা পার্থক্যের অর্থ হচ্ছে আগেরটির চেয়ে পরেরটি ভূত্বকের ভেতর ৩২ গুন বেশি শক্তিশালী৷ তবে ভূপৃষ্ঠে এই তীব্রতার পরিমাণ হয় ১০গুন বেশি৷
ভূমিকম্পের কিছু কারণ বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেছেন।
- ভূপাত : হটাৎ কোনো কারণে পাহাড় বা পর্বত থেকে যদি বিশাল শিলাখণ্ড ভূত্বকের উপরে ধসে পড়ে তখন ভূমিকম্প হয়। ১৯১১ সালে পামীর মালভূমিতে বিশাল ভূপাত হওয়ার ফলে তুরস্কে ভূমিকম্প হয়েছিল।
- আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত : অগ্ন্যুৎপাতের সময় জ্বালামুখ দিয়ে প্রবলবেগে বাষ্প বা লাভা বের হতে থাকে এর ফলে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
- হিমবাহের প্রভাব : হটাৎ করে হিমবাহ পর্বতগাত্র থেকে নিচে পতিত হলে ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে ও ভূমিকম্প হয়।
- তাপ বিকিরণ : ভূত্বক তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হলে ফাটল ও ভাঁজের সৃষ্টি হয়। এর কারণে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
ভূমিকম্পের সময় কি করা উচিত আমাদের :
ভূমিকম্পের সময় শক্তিশালী টেবিল বা এ ধনের আসবাবের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত। কোন অবস্থাতেই কাঁচের জানালার পাশে অথবা এমন দেয়াল যা পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে, তার পাশে অবস্থান নেয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি ভূমিকম্পের সময় আপনি বিছানায় থাকেন, তাহলে সেখানেই থাকুন এবং বালিশ দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখুন। তবে লক্ষ্য রাখবেন ঝাড়বাতি বা ফ্যান জাতীয় কিছু ঘরে থাকলে সেটা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। আশেপাশে শক্ত পিলার থাকলে সেটার নিচে আশ্রয় নিন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে ভূমিকম্পের সময় অধিকাংশ মানুষ আহত অথবা নিহত হন ভূমিকম্প চলাকালিন অবস্থান পরিবর্তেনের সময়। তাই কোন অবস্থাতেই ভূমিকম্প হওয়ার সময় দৌড় দেয়া অথবা দ্রুত বিল্ডিং থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। উঁচু দালানের টপ ফ্লোরে থাকলে ছাদে চলে যাওয়া নিরাপদ কিন্তু যদি দরজা বা রাস্তা পরিষ্কার জানা না থাকে তাহলে ঘরেই অবস্থান নেয়া উচিত। নিচে নামার সময় লিফট ব্যবহার করা উচিত নয়। আপনি যদি বাহিরে থাকেন এবং ভূমিকম্প হয়, তাহলে বিল্ডিং থেকে দূরে থাকুন।
আবহাওয়াবিদ ধারণা করেন যে ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা বহন করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প যে কোন সময় আঘাত হানতে পারে। আর তা যদি ঘটে, তাহলে সেটার ভয়াবহতা হবে মারাত্মক !