আকাশে পাখি উড়তে দেখলে তোমাদের সবারই ইচ্ছে হয় পাখির মতো আকাশে ভেসে থাকার। তোমাদের একার নয়, পুরো মানবজাতিরই এমন ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক। আর এই ইচ্ছে থেকেই মানুষ তার আদিকাল থেকে লালিত স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের মধ্যে অধিকাংশই হয়তো জানে না বিমান কি করে এলো, আর কেমন করেই বা বিমান বাতাসে ভেসে থাকে!
প্রথমেই জেনে নেই বিমান আবিস্কারের ইতিহাস। তোমরা সবাই হয়ত জানো যে বিমান সর্বপ্রথম আবিস্কার করেন উইলবার রাইট ও তাঁর ভাই অরভিল রাইট। ছোটবেলায় তাঁদের বাবা একটি খেলনার হেলিকপ্টার উপহার দিয়েছিলেন। এটি থেকেই দু’ভাইয়ের মনে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন শুরু হয়। অবিরাম ক্লান্তিহীন গবেষণার পর রাইট ভ্রাতৃদ্বয় ১৮৯৯ সালে তাঁদের প্রথম বিমান তৈরি করেন। পাঁচ ফুট উচ্চতার একটি বাক্সে পাখা লাগিয়ে তাঁরা এটি তৈরি করেন। পরের বছরই তাঁরা একটি ইঞ্জিনবিহীন বিমান তৈরি করতে সমর্থ হন। এই বিমানটি ১২ সেকেন্ড বাতাসে ভেসে ছিল। এভাবে তাঁরা বারবার চেষ্টা করতে থাকেন। একের পর এক ব্যর্থতা আসার পরেও তাঁরা দমেন নি। শেষ পর্যন্ত তাঁরা সফলতার মুখ দেখতে পান এবং সফল একটি বিমান তৈরি করেন। ১৯০৫ সালে বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি-র গড়ে যাওয়া বিমানের নকশা অনুসারে তাঁরা এটি তৈরি করেন।
বিমান বাতাসে কি করে ভেসে থাকে তা নিয়ে অনেক মতবাদ থাকলেও সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে – বাতাস যত দ্রুত প্রবাহিত হয় তত কম চাপ সৃষ্টি করে। বিপরীত ক্রমে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে প্রবাহিত বাতাস উইং এর নীচের তলে দ্রুত গতিতে প্রবাহিত বাতাসের চেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করে। আর এই বেশি চাপই উপরের দিকে ক্রিয়াশীল একটি বল (Lift) সৃষ্টি করে, যেটি বিমানটিকে উপরের দিকে ঠেলে এবং মাধ্যাকর্ষণজনিত নিম্নমুখী আকর্ষণ বলের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে। এই তথ্যটির অবতারণা করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর সুইশ গণিতবিদ ড্যানিয়েল বার্নোলি আর তার নামানুসারেই তথ্যটির নামকরণ করা হয়েছে “Bernoulli’s Principle”। তথ্যটি পুরোপুরি সঠিক হলেও উইং এর উপরের দিকের বাতাস কেন নীচের তলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দ্রুত প্রবাহিত হয় তার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আর এই অপূর্ণতাই আরও দ্বিধার সৃষ্টি করেছে।
ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের জনকদের একজন, জ্যাফ রাস্কিন মিডল স্কুলে থাকার সময় তার ক্লাসের বিজ্ঞানের শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “Lift যদি উইং-এর আকার অথবা এটি কী অবস্থায় আছে কিংবা কোন দিকে মুখ করে আছে তার উপর নির্ভর করে, তাহলে উইং এর সামনের অংশ নীচু করলে বিমানটি নীচের দিকে ঠেলা অনুভব না করে, মাটিতে আছড়ে না পড়ে উড়তে থাকে কী করে? আর আমরা যে কাগজের বিমান বানাই সেটার দুটো উইং’এর আকারই তো সমান ও মসৃণ; তাহলে সেটি উড়ে কী করে?”
শিক্ষক প্রথমেই তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে উইং-এর সামনের অংশ নীচু করলে বিমান কখনই উড়তে পারে না। কিন্তু রাস্কিন শিক্ষকের ব্যাখ্যা অগ্রাহ্য করে বললেন তিনি ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছেন। শিক্ষক দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেন কাগজের বিমান পুরোপুরি ভিন্ন বৈজ্ঞানিক সূত্রের উপর নির্ভর করে উড়ে। রাস্কিন বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক পুরোপুরি ভুল, অযৌক্তিক এবং অসত্য ব্যখ্যা দিচ্ছেন এবং এর প্রমাণও তার কাছে ছিল।
পরদিন রাস্কিন ক্লাসে একটি কাঠের তৈরি মডেল বিমান (Balsa-wood model airplane) নিয়ে আসলেন এবং দেখালেন যে যখন বিমানটির উইং নীচের দিকে ঘুরানো থাকে কেবল তখনই সেটি উড়ে। হেরে গিয়ে শিক্ষক অপমানিত বোধ করলেন এবং রাস্কিনকে প্রিন্সিপালের রুমে প্রেরণ করলেন। প্রিন্সিপাল তাকে আচার-আচরণে আরও সংযত এবং ভদ্র হবার নির্দেশ দিলেন।
বহুদিন পর ১৯৯৪ সালে রাস্কিন উইং সংক্রান্ত এই সমস্যা এবং উড়ন্ত বিমানের ভেতর একটি বলের কোণ সৃষ্টি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার কারণ ব্যাখ্যা করে ‘Quantum Magazine’এ একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেটিতে তিনি বলেন বার্নোলি’র তথ্যটি নির্ভুল কিন্তু শিশুসুলভ। রাস্কিন এবং অন্যান্যরা বুঝতে পারেন যে স্যার আইজ্যাক নিউটনের গতিসূত্রগুলো ব্যাপারটিকে বার্নোলি’র তথ্যের চেয়ে অধিকতর সহজে ব্যাখ্যা করতে পারে। রাস্কিন প্রবন্ধে আরও বলেন, “উইং এমন একটি বস্তু যা বাতাসকে নীচের দিকে ঠেলতে পারে।” আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র (প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে) থেকে বলা যায় উইং বাতাসকে নীচের দিকে ঠেলতে যে নিম্নগামী বল প্রয়োগ করে সেটি একটি সমান উপরিগামী বল সৃষ্টি করে, যেটি Lift সৃষ্টি করে এবং বিমানটিকে ভাসিয়ে রাখে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কতটুকু বাতাস স্থানাতরিত হবে তা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে বাতাসে উড়ার সময় উইং-এ উৎপন্ন কোণের উপর, মোটেই উইং এর আকারের উপর নয়। উইং-এ উৎপন্ন কোণটি ‘Angle of attack’ নামে পরিচিত। Angle of attack বাড়িয়েই পর্যাপ্ত Lift সৃষ্টি করে বিমান বাতাসে ভাসে।