বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। এদেশের আনাচে কানাচে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় থাকার কারণেই এমন নামকরণ। এসব নদী-নালা একদিক থেকে যেমন আমাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে, আবার বর্ষার সময় প্রায়ই অতিবৃষ্টির কারণে পানি উপচে উঠে বন্যার সৃষ্টি করে।
আমাদের দেশে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র রয়েছে যা আবহাওয়া পর্যালোচনা করে বন্যার সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং সতর্কতা জারি করে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বা FFWC (Flood Forecasting and Warning Centre) ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত। ১৯৭২ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এর যাত্রা শুরু হয়। FFWC স্থাপনার পর থেকে যে প্রশংসনীয় কাজটি করে যাচ্ছে তা হলো, তারা বন্যা সম্পর্কিত সকল তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখে। https://www.ffwc.gov.bd এই লিঙ্কে গেলেই FFWC-এর প্রদানকৃত সকল তথ্য দেখা সম্ভব। কিন্তু আসলে বন্যা হবে কি হবে না তা কীভাবে বের করা হয়?
বাংলাদেশে প্রধানত মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে, আকস্মিক পাহাড়ি ঢলের ফলে, নিষ্কাশন ব্যবস্থার সমস্যার কারণে, এবং জলোচ্ছ্বাসের কারণে বন্যা সংঘটিত হয়। আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং নদ-নদী সমুহের বিদ্যমান পানি সমতলের অবস্থা বিবেচনা করে গাণিতিক মডেলের সাহায্যে ভবিষ্যতে পানি সমতলের অবস্থা কি হতে পারে তা হিসাব করে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ বার্তা তৈরী করা হয়।
বন্যার পূর্বাভাস বের করার জন্য FFWC কিছু ডাটা বা উপাত্ত সংগ্রহ করে। এই উপাত্তগুলো হল- আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য, স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি, বৃষ্টিপাতের তথ্য এবং ভারত থেকে প্রাপ্ত কিছু আবহাওয়া ষ্টেশনের নদীর পানির পরিমাণ সম্পর্কিত তথ্য।
এসব সংগৃহিত তথ্য-উপাত্ত নদ-নদীর ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ভিত্তিক গাণিতিক মডেলে ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করে "মডেল সিমুলেশনের" মাধ্যমে প্রধান প্রধান নদ-নদীর নির্দিষ্ট স্থানে পানি সমতলের ভবিষ্যতের অবস্থা (উচ্চতা), বর্তমানের তুলনায় ভবিষ্যত পানি সমতলের উচ্চতার পরিবর্তন (হ্রাস বা বৃদ্ধি) এবং ঐ স্থানে বিপদসীমার তুলনায় পানি সমতলের উচ্চতার হিসাব করা হয়।
সকল পূর্বাভাস পয়েন্টে পানি সমতল ভিত্তিক "হাইড্রোগ্রাফের" সাহায্যে বন্যা অবস্থার বিবরণ, পূর্বাভাস প্রনয়ন এবং প্রচার ও বিতরন করা হয়। "হাইড্রোগ্রাফ" হচ্ছে কোন স্থানের সময়ের সঙ্গে সমতলে পানির উচ্চতার পরিবর্তন নির্দেশক লেখচিত্র। এই সমস্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। ওয়েবসাইট ছাড়াও যেকোনো মোবাইল থেকে ১০৯৪১ ডায়াল করলেও প্রতিদিনের সর্বশেষ বন্যাসম্পর্কিত তথ্য শোনা যাবে।
বন্যা সতর্কীকরণের জন্য মূলত নিচের সংকেত জারি করা হয়-
১) সতর্ক অবস্থাঃ কোন নির্দিষ্ট স্থানের পানি ঐ স্থানের বিপদ সীমার নিচে ৫০ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকলে তা ওই স্থানের জন্য বন্যা সতর্ক অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২) সাধারণ বা স্বাভাবিক বন্যাঃ কোন নির্দিষ্ট স্থানের পানি ওই স্থানের বিপদসীমার উপরে বিপদসীমা হতে ১০০ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকলে তা ওই স্থানের জন্য সাধারণ বা স্বাভাবিক বন্যা অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৩) ভয়াবহ বন্যাঃ যখন পানি সমতল কোন স্থানের বিপদসীমার চেয়ে ১০০ সেন্টিমিটারের বেশী উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন তা ওই স্থানের জন্য ভয়াবহ বন্যা হিসাবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র তাদের স্থাপনের সময় থেকে একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচ্ছে। যা ব্যবহার করে বর্তমানে ৫ দিনের বেশী আগে কোন বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। ডেনমার্কের সহায়তায় স্থাপিত Mike 11 River Routing Model-এর সাহায্যে FFWC পূর্বাভাস দিতে চেষ্টা করে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যাগুলোর মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যাই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। এরপর ১৯৯৮ সালের বন্যা এদেশের অধিকাংশ এলাকা ডুবিয়ে দেয়। এ বন্যা স্থায়ী ছিল প্রায় তিন মাস। এরপর আবার ২০০৪ সালে বেশ বড় একটি বন্যা দেখা দেয়। এরপর আর তেমন ভয়াবহ কোন বন্যা দেখা দেয়নি, কিন্তু এ বছর যে হারে বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তার ফলে আবার একটি ভয়াবহ বন্যা আসবে না তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না ! এরই মধ্যে আটটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলাগুলো হলো বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারী। বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় আগামী কয়েক দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।