দুই ধারে দৃষ্টিনন্দন স্থলভুমি, আর মাঝ দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমান জল। এই ধরনের পানিপথকেই বলা হয় প্রণালী (Strait)। প্রণালী হল দুটি নদী বা সমুদ্রের সংযোগকারী সংকীর্ণ জলপ্রবাহ বা ধারা। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের আগে যখন জলপথ ছিল দুটি দেশের মাঝে যোগাযোগের সেরা মাধ্যম, তখন থেকেই মানুষ বিভিন্ন প্রণালীর গুরুত্ব বুঝতে পারে। এই প্রণালীগুলো শুধু প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং মানবজাতির উন্নয়নের ইতিহাসেও তাদের রয়েছে প্রত্যক্ষ অবদান।
জিব্রাল্টার প্রণালী:
পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রণালী বলা যায় জিব্রাল্টার প্রণালীকে। দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সাগরকে এক করার গুরুদায়িত্ব গ্রহন করেছে এই জিব্রাল্টার প্রণালী। এর পশ্চিমে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর আর পূর্বে রয়েছে ভূমধ্যসাগর (Mediterranean Sea)। এছাড়া, এটির উত্তর দিকে রয়েছে স্পেন এবং রক অব জিব্রাল্টার আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে মরক্কো এবং উত্তর আফ্রিকা। বিমান আবিষ্কারের আগে আটলান্টিক আর ভূমধ্যসাগরের মাঝে প্রায় সকল ব্যবসায়িক বেচাকেনা হতো এই প্রণালীর মাধ্যমে। বর্তমান সময়েও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য এই প্রণালীটি গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু ব্যবসা নয়, ভিন্নধর্মী সব সংস্কৃতিকেও এক করেছে এই জিব্রাল্টার প্রণালী। উত্তর দিকে ইউরোপিয়ান ও খ্রিস্টান সংস্কৃতি বজায় রয়েছে, আর দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকাতে রয়েছে মুসলিমদের আধিপত্য। এছাড়া, পাখিদের কাছেও জিব্রাল্টার প্রণালী খুব প্রিয় একটি স্থান। প্রতি বছর হাজারো প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি ভূমধ্যসাগর থেকে আটলান্টিকে যেতে এই প্রণালী ব্যবহার করে। গ্রিক মিথলজিতে এই প্রণালীকে “হারকিউলিসের পিলার” নামেও অবিহিত করা হয়। এছাড়া, ইউরোপের খুব নিকটবর্তী হওয়ায় অবৈধ অভিবাসীরা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে যেতে এই পথ ব্যবহার করে থাকেন।
মালাক্কা প্রণালী:
৮০৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সরু মালাক্কা প্রণালী মালয় উপদ্বীপ এবং সুমাত্রার ইন্দোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মাঝে অবস্থিত। এটি পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেন। ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী প্রধান শিপিং চ্যানেল এটি। এশিয়ার অর্থনীতির বিরাট একটি অংশ মালাক্কা প্রণালীর উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর মোট রপ্তানি করা পণ্যের ৪ ভাগের ১ ভাগ এই প্রণালী দিয়েই গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। তবে এই সরু প্রণালীর পক্ষে এতো পণ্যের বোঝা বহন করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। জলদস্যুদের হামলার আতঙ্ক তো আছেই, তার উপর জাহাজডুবির ঘটনাও এখানে নতুন কিছু নয়।
সরু প্রণালীতে বিশাল সব তেলবাহী জাহাজ ভিড় করায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। থাই সরকার তাই মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প হিসাবে ইস্থুমাস অব ক্রা এর মাঝ দিয়ে খাল কেটে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে নতুন একটি প্রণালী করার পরিকল্পনা করেছিল তবে সেটা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। মালাক্কা প্রণালীর উপকূলে অবস্থিত প্রধান বন্দরগুলির মধ্যে আছে মালয় উপদ্বীপের পেনাং, পোর্ট ক্লাং ও মালাক্কা, এবং সুমাত্রা দ্বীপের বেলাওয়ান বন্দর। সিঙ্গাপুর এই প্রণালীর দক্ষিণতম প্রান্তে অবস্থিত।
পক প্রণালী:
ভারতের তামিলনাড়ু থেকে শ্রীলংকার উত্তর প্রদেশের মান্নার ডিসট্রিক্ট পর্যন্ত বিস্তৃত পক প্রণালীটি ৪০-৮৫ মাইল প্রশস্ত। এটি বঙ্গোপসাগরকে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে পক উপসাগরের সাথে এবং দক্ষিন-পশ্চিম দিক থেকে মান্নার উপসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। পক প্রণালীর আশপাশ দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ও ফেরি চলাচল করে। প্রণালীর অগভীর পানি ও প্রবালপ্রাচীরের জন্য বড় জাহাজ এখান দিয়ে সহজে চলাচল করতে পারে না, তবে ছোট ছোট নৌকা ও মাছ ধরার জাহাজ শতশত বছর ধরে এখান দিয়ে চলাচল করছে।
বন্দর হিসাবে পক প্রণালীর সুখ্যাতি না থাকলেও ধর্মীয় দিক দিয়ে এটি অনেকের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। জাহাজ বন্দরের জন্য বেশ কয়েকবার প্রণালী কেটে শিপিং ক্যানেল তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সফল হয়নি। হিন্দু ধর্মের মহাকাব্য রামায়ণ অনুযায়ী অসুরের রাজা রাবণের হাত থেকে সীতাকে রক্ষা করার জন্য বানারসের একদল যোদ্ধার সাহায্য নিয়ে রাম এই প্রণালীর মধ্য দিয়ে পাথরের সেতু নির্মাণ করেছিলেন। তাই, প্রণালীর মাঝে থাকা ছোটছোট পাথুরে প্রবাল দ্বীপগুলো ভেঙ্গে শিপিং ক্যানেল তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হলে তা পরবর্তীতে হিন্দুদের আন্দোলনের মুখে বাদ দিতে হয়।
সিঙ্গাপুর প্রণালী:
১০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৬ কিলোমিটার চওড়া সিঙ্গাপর প্রণালীটির পশ্চিমে রয়েছে মালাক্কা প্রণালী ও পূর্বে রয়েছে দক্ষিন চীন সাগর। চ্যানেলের উত্তর দিকে রয়েছে সিঙ্গাপুর। এই প্রণালীতে কেপ্পেল হারবোর (Keppel Harbour) ছাড়াও বেশ কিছু ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। সিঙ্গাপুর বন্দরে পৌঁছানোর অন্যতম জলপথ এটি। নবম শতকে মুসলিম লেখক ইয়াকুবি সিঙ্গাপুর প্রণালীকে Sea of Salahit নামে অবিহিত করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই প্রণালীর পথে মাইন স্থাপন করা হয়েছিল।