প্রযুক্তির নানা সুযোগ সুবিধা আমাদের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন থেকে শুরু করে কেনাকাটাসহ নানা সুবিধা আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে গ্রহণ করছি। ঈদ আসন্ন। তাই অফিস আদালতও বন্ধ থাকছে। এটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগতে পারে সাইবার অপরাধীরা। এজন্য অনলাইনে যেসব সেবা গ্রহণ করতে পারি সেগুলোর বিষয়ে প্রত্যেকের সতর্কতারও প্রয়োজন।
সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে ব্যবহারের আগে জানতে হবে কিভাবে ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকা যায়। শিক্ষামূলক ও সামাজিক যোগাযোগে বিভিন্নভাবে শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক সবাইকে সাহায্য করে ইন্টারনেট। কিন্তু সতর্কতার অভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে যে কেউ।
অনলাইন সুরক্ষা
১. কঠিন পাসওয়ার্ড: মোবাইল ব্যাংকিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইমেইলসহ যেকোনো অ্যাকান্টের পাসওয়ার্ড কখনোই ব্যক্তিগত কোনো কিছুর নামে যেমন: পোষাপ্রাণী, প্রিয়গান, প্রিয় ব্যক্তি ইত্যাদি হওয়া উচিত নয়। পাসওয়ার্ড সাধারণত ছোট-বড় হাতের অক্ষর, শব্দ ও সংখ্যার সমন্বয়ে হওয়া উচিত। প্রত্যেক আলাদা অ্যাকাউন্টে আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
২. সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টে প্রাইভেসি: যাতে আপনার বন্ধুরা ছাড়া অন্যরা আপনার শেয়ার করা কনটেন্ট দেখতে না পারে সেজন্য প্রাইভেসি সেটিংসে ‘ফ্রেন্ড’ করে রাখুন। যদি ‘পাবলিক’ করে দেয়া থাকে তাহলে যে কেউ আপনার সম্পর্কে জেনে যাবে এবং তথ্যের অপব্যবহার করতে পারে।
৩. একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য না দেয়া: অনলাইনে নিজের ফোন নম্বর, ঠিকানা ইত্যাদি দেয়া উচিত নয়। পরিবারের কারো তথ্যও দেবেন না।
৪. ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার না করা: যেমন যদি স্কুলের শার্ট পরে ছবি শেয়ার করেন, তবে যে কারো পক্ষে আপনার তথ্য জানা সহজ হয়ে যাবে। যদি কেউ অনলাইনে আপনার ছবি পেতে চায়, সরাসরি ‘না’ বলে দিন।
৫. অন্যের কম্পিউটারে কাজ নয়: নিজের কম্পিউটার ছাড়া আপনি যদি আপনার বন্ধুর বা পরিচিত অন্য কারো কম্পিউটার ব্যবহার করেন, তাহলে সেখানে যেকোনো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট (যেমন: অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট, ইমেইল ইত্যাদি) লগইন করবেন না। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ডিভাইস ছাড়া অন্য কোথাও ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে কাজ করা উচিত নয়।
৬. অর্থ সম্পর্কিত তথ্যের সুরক্ষা: টাকা, ব্যাংকের চেক, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদির ছবি শেয়ার করবেন না।
৭. লোকেশন অফ রাখুন: কিছু আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন ফোনে (স্মার্টফোন) লোকেশন দেয়া থাকে, যা চালু করা থাকলে আপনার শেয়ার করা কন্টেন্টে লোকেশন দেয়া থাকে। এর মাধ্যমে যে কারো পক্ষে আপনার অবস্থান জানা সহজ হবে এবং খারাপ উদ্দেশে আপনাকে অনুসরণ করতে পারে।
৮. আকর্ষণীয় কিছুর লোভ থেকে সাবধান: বিজ্ঞাপন, প্রতারণা এবং ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে স্প্যাম হয়। মোটা অংকের টাকা অথবা আকর্ষণীয় পুরস্কার জেতার লোভ দেখিয়ে ইমেইলের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়া হয়। এগুলোকেই স্প্যাম বলে। এগুলো এড়িয়ে চলুন।
ধরুন আপনার নাম উল্লেখ করে কেউ অনলাইনে আপনাকে ‘হাই’ লিখলো। কিন্তু আপনি বাস্তবে তাকে চেনেন না। এমন প্রতারকরা আপনার ইমেইল ঠিকানার মাধ্যমেও আপনার নাম জানতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
অপরিচিত কোনো ঠিকানা থেকে ইমেইল পেলে সেটি খুলে দেখা উচিত নয়। এমনকি ইমেইলে ‘এখানে ক্লিক করুন’ এই ধরনের কিছু লেখা থাকলে বা আকর্ষণীয় কোনো কিছুর কথা বলা হলে সেখানে ক্লিক করা উচিত নয়। কারণ এগুলোতে একটি ক্লিকেই ভাইরাস বা ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে আপনার কম্পিউটারের বারোটা বেজে যেতে পারে!
৯. নির্ভরযোগ্য কেনাকাটার ওয়েবসাইট ব্যবহার: প্রায়শই অনলাইন শপগুলো পণ্য বিক্রির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে প্রচার চালায়। শুধু বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটগুলো থেকেই পন্য কিনুন।
১০. এন্টি ভাইরাস আপডেট রাখুন: এটি আপনার কম্পিউটারকে ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখবে। ভাইরাস ও ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি অথবা কম্পিউটারের কোনো ক্ষতি করতে পারে।
১১. মোবাইল ব্যাংকিং: মোবাইল ব্যাংকিং করেন, এমন ফোন সেট যেন অবশ্যই সবসময় ‘লকড’ থাকে। লক করার সময় মনে রাখবেন ফোনের প্যাটার্ন লকের চেয়ে কঠিন পিন লক ব্যবহার নিরাপদ। কোনো পাসওয়ার্ড/পিন/সিকিউরিটি কোড ফোনে সেভ করে রাখবেন না। মোবাইলের সিস্টেম আপডেট চালু রাখুন ও নিয়মিত হালনাগাদ করুন।
ফোন অনুযায়ী কেবল গুগল প্লে স্টোর/আইওএস অ্যাপ স্টোর/উইন্ডোজ স্টোর থেকে প্রয়োজনীয় অ্যাপ সংগ্রহ করুন। শেয়ার ইট দিয়ে বা অন্য কোনো সাইট থেকে অ্যাপ নামিয়ে ইনস্টল না করাই ভালো। থার্ড পার্টি অ্যাপ ‘আলাউ’ নিষ্ক্রিয় রাখুন। প্রয়োজন ছাড়া ব্লুটুথ ও ওয়াইফাই চালু না রাখাই ভালো। ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন, এতে যেকোনো সময় হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারেন। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা এমএমএস, ব্লুুটুথ বা ওয়াইফাই ফাইল গ্রহণ ও খোলা থেকে বিরত থাকুন।
অটোম্যাটিক কল অ্যান্সার ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ ব্যবহার করা হুমকিদায়ক।
সামাজিক যোগাযোগ
১২. অপরিচিত মেসেজ এড়িয়ে চলা: যেভাবে রাস্তায় চলাফেরার সময় অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয় তেমনি অনলাইনেও। কারণ যার সঙ্গে কথা বলবেন সে মিথ্যা পরিচয় ধারণকারী বিপজ্জনক হতে পারে। যদি কথা বলতেই হয়, তবে সাবধান! নিজের ঠিকানা, বয়স, স্কুল, শ্রেণী, পেশা ইত্যাদি বলা যাবেনা।
সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট যেমন: ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপ- ব্যবহারে অপরিচিত কারো অনুরোধ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা ভালো। এক্ষেত্রে ভুয়া আইডি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সাইবার অপরাধীরা আপনাকে বিভিন্নভাবে প্রলুদ্ধ করবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে। শুধু পরিচিতদের ফ্রেন্ড/ফলোয়ার লিস্টে রাখুন।
১৩. অপরিচিত কারো সঙ্গে সাক্ষাতে সতর্কতা: অনলাইনে কারো সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠলে এবং তিনি বিশ্বাসযোগ্য কেউ হলেও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। প্রথমত মা-বাবার অনুমতি নিতে হবে দেখা করার আগে এবং পারলে কাউকে সঙ্গে নেয়া ভালো। আর সাক্ষাত অবশ্যই মানুষের উপস্থিতি আছে, এমন খোলামেলা কোনো জায়গায় হওয়া উচিত। এতে সন্দেহজনক কিছু ঘটলেও পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে পড়বে সহজে।
১৪. প্রাইভেট ফোরাম ও চ্যাট রুমের বিষয়ে সতর্কতা: ফোরামে প্রবেশ মানেই নিজের ব্যক্তিগত ইমেইল ও ঠিকানা অন্য কেউ জেনে ফেলা। এতে আপনার অবস্থান খুঁজে বের করা খুবই সহজ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত এসব চ্যাটরুমে বড়রা প্রায়শই থাকে কম বয়সীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
১৫. ডেটিং সাইট এড়িয়ে চলা: ডেটিং সাইটগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এখানে আপনি জানতে পারেন না যে, কার সঙ্গে কথা বলছেন। বয়স্করাও স্বার্থেও জন্য টিনেজার সাজে এখানে।
রিপোর্টিং
১৬. বিরক্তিকর কিছু দেখলে জানান: যদি অনলাইনে কেউ আপনাকে বিরক্ত করে, যেমন ফোন নাম্বার, ছবি, মেইল চায় তাহলে তা পরিচিত কাউকে জানিয়ে রাখুন।
১৭. রিপোর্ট করুন: কারো শেয়ার করা কিছু যদি আপনার খারাপ মনে হয় তবে তার জন্য সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের রিপোর্ট বাটন ব্যবহার করুন। এর ফলে কে আপনার সঙ্গে কী ধরনের খারাপ আচরণ করছে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
আসুন, আমরা সচেতন হই। নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার করি। নিশ্চিত করি নিরাপদ সাইবার পরিভ্রমণ।
পরামর্শ দাতা:
মো. মেহেদী হাসান, সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষক ও গবেষক