আমাদের এ পৃথিবীতে মূল্যবান অনেক পাথর আর খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। খনি থেকে পাওয়া পাথরের মধ্যে অনেকগুলোই অত্যন্ত দুর্লভ এবং বহু গুনাগুনে সমৃদ্ধ। এসব পাথর দেখতে যেমন অত্যন্ত সুন্দর তেমনি এদের বাজারদরও অনেক। হীরা, চুনি, পান্না, নীলা এরকম বহু মূল্যবান পাথর পৃথিবীর বুকে পাওয়া যায় যেগুলো মানুষের বহুল আকাঙ্ক্ষার বস্তু। এসব রত্ন পাথরের রয়েছে অনেক ইতিহাস, এদের গঠন উপাদান ও প্রকৃতি হয়ে থাকে বিভিন্ন, এদের সন্ধানও মেলে ভিন্ন জায়গায়, অনেক জায়গায় অনেক রত্নকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়ে থাকে। মহামূল্যবান বিভিন্ন সব রত্নপাথরের এরকম অনেক তথ্য আমরা জানবো আমাদের এই আয়োজনে। আজকে আমরা জানবো নীলা বা নীলমণি নিয়ে।
বহুকাল আগে মানুষ আকাশের নীল রঙ দেখে বিশ্বাস করতো, পৃথিবী আসলে নীল রঙের কোন চকচকে রত্ন দিয়ে মোড়ানো। আর এই নীল রঙের পাথর হচ্ছে স্যাফায়ার বা নীলমণি। বিশেষ করে সন্ধ্যার গাঢ় নীল রঙের আকাশের সাথে নীলমণির পার্থক্য করা সত্যি কঠিন।
স্যাফায়ার (Sapphire) শব্দটি মূলত এসেছে গ্রীক শব্দ sapphiros থেকে যার অর্থ নীল পাথর। তবে মূল শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শানিপ্রিয়া’ থেকে। স্যাফায়ার ভারতীয় উপমহাদেশে নীলকান্তমণি বা নীলমণি অথবা নীলা নামে পরিচিত।
পূর্ববর্তী পর্বে আমরা রুবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। রুবি হলো এলুমিনিয়াম অক্সাইড দিয়ে গঠিত একটি রত্ন বিশেষ। এই নীল রঙের রত্নের গঠনও একদম রুবির মতো। তবে রুবিতে এলুমিনিয়াম অক্সাইডে ক্রোমিয়ামের আধিক্যের জন্য এটি রক্ত বর্ণ হয়। অপরদিকে নীলমণিতে এলুমিনিয়াম অক্সাইডের সাথে থাকে টাইটেনিয়াম যৌগ, যার কারণে খালি চোখে এর রঙ নীল দেখায়।
স্যাফায়ারের প্রধান রঙ হচ্ছে নীল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় ৫০ ভাগ লোকের সবচেয়ে পছন্দের রঙ নীল। নীল রঙ সহমর্মিতা, ঐক্যমত, ভালবাসা এবং বিশ্বস্ততার প্রতীক। নীলা প্রধানত অলংকার হিসেবেই বেশি জনপ্রিয়। তবে ঘড়ি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কাজে এই পাথর ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সহনশীলতা এবং কাঠিন্যের দিক দিয়ে পৃথিবীর সকল খনিজের মধ্যে নীলমণি বা নীলার অবস্থান তৃতীয়। Mohs scale of mineral অনুযায়ী নীলার কাঠিন্য ৯.০। প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা হীরা এবং ময়সানাইটের কাঠিন্য যথাক্রমে ১০ এবং ৯.৫।
যে সকল নীলায় টাইটেনিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, সেগুলো খুব স্বচ্ছ হয়। আলোর উপস্থিতিতে এর বর্ণচ্ছটা অনেক দিকে প্রতিফলিত হয়। অবস্থানের কারণে নীলার বর্ণের পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বাইরের আলোয় নীলাকে মনে হবে নীল, কিন্ত ভেতরকার আলোয় অনেকটা বেগুনী মনে হয়। ফ্লোরেন্স লাইট বা টিউব লাইটের নিচে নীলাকে গোলাপিও মনে হতে পারে। আবার সূর্যালোকে অনেকটা সবুজ এবং হলুদাভ ভাব হয়ে থাকে।
অন্যান্য রত্নের মতো নীলাও গভীর খনি থকে উত্তোলন করতে হয় এবং এর খনির সংখ্যা খুব বেশি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা, অস্ট্রেলিয়ার অ্যানিটি, শ্রীলংকার রত্নপুরা নীলার খনি হিসেবে সুপরিচিত। কাশ্মীর অঞ্চলে প্রায় সাড়ে চারহাজার ফুট উঁচুতে নীলার খনি রয়েছে। এই খনি বছরের বেশীরভাগ সময়ই বরফে ঢাকা থাকে। শুধুমাত্র জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এই খনি থেকে নীলা উত্তোলন করা সম্ভব হয়। পৃথিবীর অন্য কোন অঞ্চলের নীলা অপেক্ষা কাশ্মীরি নীলার কদর সবচাইতে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে মাদাগাস্কার, তানজানিয়া এবং ব্রাজিলেও নীলমণির খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
পৃথিবীর সব থেকে বড় নীলা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’ নামের ৫৬৩ ক্যারটের একটি নীলা কে। বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রাকৃতিক যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।