বেড়াই বাংলাদেশে : পর্ব ১

বাংলাদেশ। প্রকৃতির সব রং আর সব রূপের পসরা সাজিয়ে বসা বৈচিত্র্যময় এক দেশ। এই দেশে ঘুরে দেখার আছে অনেক কিছুই। ছুটির দিনে তাই ঘরে বসে না থেকে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে। এতে আপনার ছোট্ট সোনামনি যেমন আনন্দ পাবে, তেমনি বাড়বে তার জ্ঞানের পরিধি। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক- ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, মানুষের বৈচিত্র্য থেকে যেমন শিক্ষা নিতে পারবে, তেমনি জানবে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকেও। ক্লাসের পড়ার চাপ থেকে একটুখানি দম ফেলার ফুসরত আর ভাল মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার জন্য ঘোরাঘুরির বিকল্প নেই। তাই সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকার আশেপাশে আর বড় ছুটি পেলে একটু দূরে বেড়িয়ে আসতে পারেন অনায়াসে। পরিবারকে কোয়ালিটি টাইমও দেয়া হলো, আর সেই সাথে ঘুরে দেখা হলো দেশটাকেও। এবারে বাংলাদেশের চারটি বিভাগীয় শহরের কিছু ঘোরার স্থান দেয়া হলো। পরের পর্বে বাকি বিভাগীয় শহরগুলোর বর্ণনা দেওয়া হবে।

ঢাকা:
নিত্যদিনের চেনা ঢাকা শহর। জ্যাম আর দূষণে ভরা। তবুও এই শহরেরও একটা অচেনা রূপ আছে, ভোরবেলার বা ছুটির দিনের। ঢাকায় মুঘল আমলের ইতিহাসের ছিটেফোটা এখনো হারিয়ে যায়নি। পুরনো ঢাকায় রয়েছে বহু প্রাচীন বাড়ি, উপাসনালয়। রয়েছে নবাব বাড়ি, লালবাগ দূর্গ। নতুন ঢাকায় বাংলা একাডেমির পাশে মীর জুমলার তৈরি ঢাকা গেট, তার পাশেই বহু পুরনো এক মসজিদ। এমনকি ধানমন্ডির ঈদগাহ মাঠ, সাত মসজিদও মুঘলদের ইতিহাস নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মুঘলদের তৈরি রমনা পার্ক এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে। সকালবেলায় হাঁটতে গিয়ে চিনে নিতে পারেন পৃথিবীর দুর্লভ সব গাছ। বোটানিক্যাল গার্ডেনেও গাছ  রয়েছে, রয়েছে অনেক রকমের পাখি। চিড়িয়াখানায়ও ছুটির দিনে ঘুরে আসতে পারেন। ঘরে বসে টিভিতে বিভিন্ন পশুপাখি দেখার চেয়ে সামনাসামনি দেখার মজাই আলাদা। জাতীয় যাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরও হতে পারে ছুটির দিনের গন্তব্য। আর যদি লম্বা সফরে যেতে চান- তাহলে বেড়িয়ে আসতে পারেন সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ইসলামপুরে কুমারদের বানানো মাটির জিনিস দেখতে।

Ahsan-Manjil
ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রাম:
চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাসও কম পুরনো নয়। বাংলার ইতিহাসের সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর ছিল বিদেশি বণিকদের স্বর্গ। সেই বন্দরনগরী আর নেই, তবে ঔপনিবেশিক শাসনামলের স্থাপত্য এখনো রয়ে গেছে। আর রয়েছে পাহাড়- নদী। চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ফয়’স লেক। রেলের কর্মচারীদের পানির ব্যবস্থা করতেই বৃটিশ শাসনামলে তৈরি করা হয় এই লেক। লেকের সাথেই রয়েছে  ছোট্ট চিড়িয়াখানা। আগ্রাবাদ এলাকায় রয়েছে জাতিতাত্ত্বিক যাদুঘর। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, বাটালি পাহাড়, বায়েজিদ বোস্তামরি মাজার, লালদীঘি ও তার সাথে লাগোয়া কোর্ট বিল্ডিং, ডিসি হিল চট্টগ্রামের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া বাংলাদেশ আর্মির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ভাটিয়ারি আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষত্রে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিও উল্লখেযোগ্য।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন  এসি, নন এসি বাস চট্টগ্রামে যায়। ট্রেনে ভ্রমণও বাচ্চাদের জন্য দারুণ উপভোগ্য হতে পারে। আর সময় বাঁচানো আর খরচ চিন্তার ব্যাপার না হলে আধ ঘন্টায় চট্টগ্রাম যেতে পারেন বিমানে করে।

খুলনা:
খুলনা শহর বাংলাদেশের সবচাইতে সুন্দর শহর। প্রশস্ত রাস্তা, রাস্তার মাঝখানে গাছপালা ছায়া দিয়ে যায় রাজপথে। যানজট নেই, কোলাহল নেই। শিববাড়ি মোড়ের কাছেই প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। আর গোটা খুলনা শহর জুড়ে আগেকার দিনের ঘরবাড়ি, মন্দির আর মসজিদে ভরা। খুলনার রূপসায় পিঠাভোগ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষদের আদিভিটা। সেখানে প্রতি বছর রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর মেলা বসে। রূপসাতেই রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীনের সমাধিসৌধ। রাড়ুলি গ্রাম হচ্ছে আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মস্থান। ফুলতলার দক্ষিণডিহি গ্রামের সাথেও ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক নিবিড়- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি এখানেই। ২৫ বৈশাখ ও ২২ শ্রাবণ এখানে রবীন্দ্র উৎসব পালন করা হয়। বকুলতলা জেলা প্রশাসকের বাংলোতে খুলনার এককালের প্রশাসক, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাস করতেন। এই বাংলোর বকুলতলায় বসেই তিনি রচনা করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রেমের উপন্যাস কপালকুন্ডলা। গল্লামারী বধ্যভূমি ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর বর্বরতার স্মৃতি বহন করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে খুলনার বীরত্বগাথার স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি স্থান শিরোমণি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও খুলনা স্বাধীন হয়েছিল এক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর। এখানে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। খুলনার নাম শুনলে আরো একটি জায়গার কথা মনে আসে- সেটা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন- সুন্দরবন। খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর, মহারাজপুর, কয়রা, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের সীমানায় অবস্থিত সুন্দরবনের একাংশ। ঢাকা থেকে বিভিন্ন  এসি, নন এসি বাস খুলনায় যায়। যায় ট্রেনও। সময় বাঁচাতে যেতে পারেন বিমানে চড়েও। তবে বিমানে আপনি সরাসরি খুলনা যতেে পারবনে না। বিমানে যশোরে পোঁছে বাসযোগে আপনাকে খুলনা যেতে হবে।

Lalbagh_Kella_Lalbagh_Fort_Dhaka_Bangladesh_2011_28
লালবাগ কেল্লা । ছবি : সংগৃহীত

বরিশাল:
বরিশাল শহরে দেখার জায়গা কম নেই। বরিশাল যেতেই হয়ে যেতে পারে এক দফা অ্যাডভেঞ্চার। বৃটিশ আমলের প্যাডেল স্টিমারে করে বরিশাল যাওয়া, আর নদীর ধারের মানুষের জীবনযাত্রা দেখার মজাই অন্যরকম। কীর্তনখোলা নদীবন্দরে সন্ধ্যেবেলা নৌকায় করে গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুকের ডিগবাজি দেখা মন্দ লাগবে না। বরিশাল সদরে রয়েছে মুঘল আমলের কড়াপুর মিয়াবাড়ি মসজিদ। বাকেরগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে কলসকাঠি জমিদারবাড়ি। এখানেই রয়েছে পাদ্রি শিবপুর গির্জা। আঠারো শতকে বরিশালে পর্তুগিজ বসতির চিহ্ন। এখানে এখনো পর্তুগিজ ইমারত, স্মৃতিসৌধ আর রোমান ক্যাথলিক গির্জা রয়েছে। বরিশালের কাশিপুরে রয়েছে আরো একটি জমিদার বাড়ি- লাখুটিয়া। মুঘল আমলে লাখুটিয়ার জমিদারেরা বেশ প্রভাবশালী ছিল বলে জানা যায়। এখানে এখনো দু’টি বাড়ি, তিনটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। মুঘল আমলের আরো একটি মসজিদ রয়েছে গৌরনদীতে। লাখেরাজ কসবায় অবস্থিত এই মসজিদের নাম কসবা মসজিদ। এখানে পাশেই রয়েছে হযরত মল্লিক দূত কুমার শাহ ( রাঃ ) এর মাজার। মাহিলাড়া মঠও গৌরনদীতে। নবাব আলীবর্দী খানের সময়ে সরকার রূপম দাসগুপ্ত এই মঠটি তৈরি করান। এছাড়াও মেহেদিগঞ্জের উলানিয়া জমিদার বাড়ি, চরামদ্দি ইউনিয়নের চরামদ্দি মুঙ্গাখান জামে মসজিদ, উজিরপুরের গুটিয়া মসজিদ বেশ জনপ্রিয় দর্র্শনীয় স্থান। ১৭৮০ সালে চন্দ্রদ্বীপ পরগণার জমিদার রাজা শিবনারায়ণ এলাকার মানুষের পানির কষ্ট দূর করতে বাবুগঞ্জে খনন করান দূর্গাসাগর। দূর্গাসাগরের পাশেই বানারীপাড়ায় রয়েছে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক যাদুঘর।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন নন এসি বাস বরিশাল যায়। স্টিমার বা লঞ্চভ্রমণও বাচ্চাদের কাছে মজার অভিজ্ঞতা হবে।

টিপস:
১.   ট্রিপ পরিকল্পনার  সময় বাচ্চাদের সম্পৃক্ত রাখুন, তাদের মতামত নিন।
২.   একটি ভ্রমণের খসড়া পরিকল্পনা করে ফেলুন (অবশ্য পরিকল্পনা ছাড়া বেড়াতে বের হওয়ার অন্য রকম মজা রয়েছে)।
৩.   সবার প্রয়োজনীয় ওষুধ প্যাক করে নিন। সেই সাথে ফার্স্ট এইড বক্সও।
৪.   সব সময় একটা বিকল্প পরিকল্পনা করে নিন।
৫.   যেখানে যাচ্ছেন বা যেতে চান, সে ব্যাপারে বাচ্চাদের আগেই পড়াশোনা করে নিতে বলতে পারেন।
৬.   ভ্রমণের সময়ে বাচ্চাদের জন্য কিছু ফান অ্যাক্টিভিটি পরিকল্পনা করে রাখুন।
৭.   কিছু হালকা খাবার সবসময় সাথে রাখবেন।
৮.   হোটেল বা থাকার জায়গা বা যেখানে বেড়াতে যাবেন তার পরিবেশ সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করে নিন।
৯.   এলাকার জলবায়ু, আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণা নিয়ে ব্যাগে কাপড়-চোপড় নিন।
১০. প্রচুর মজা করুন, মাথায় রাখবেন- ট্রাভেলে প্যারেন্টস খুশি মানেই বাচ্চারা খুশি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন