পয়লা বৈশাখ বাঙালি জীবনের একটি সার্বজনীন উৎসব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ মেতে উঠে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ উদযাপনের আনন্দে। পন্ডিতদের মতে, ‘খ্রীস্টাব্দ, হিজরী কিংবা বঙ্গাব্দের কোন বছরের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের কোনো যোগ নেই।
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ (মতান্তরে ১১ মার্চ) থেকে বাংলা সন গননা শুরু হয়। তবে আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সনের কার্যকারিতা ধরা হয়। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিত হয়।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। সৌর পঞ্জিকারটির শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালিত হতো ‘আর্তব উৎসব’ বা ‘ঋতুধর্মী’ উৎসব হিসেবে।
ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল। এ কারণে কৃষকদের কৃষি ফলনের সঙ্গে খাজনার সময় মিলতো না। খাজনা সুষ্ঠুভাবে আদায়ের লক্ষ্যে মোঘল সম্রাট আকবর বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজির নেতৃত্বে সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের মধ্যে সময়ের সমন্বয় করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম চালু করেন।
এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কালকে চন্দ্রমাস এবং এক সংক্রান্তি থেকে আরেক সংক্রান্তি পর্যন্ত সময়কালকে সৌর মাস বলা হয়। সূর্য রাশিচক্র বা ক্রান্তিবৃত্তের ওপর দিয়ে চলতে চলতে যেদিন মেষরাশিতে প্রবেশ করে, সেদিন থেকে বাংলা নতুন বছর শুরু হয় এবং বাংলা বছরের প্রথম দিনটিই হচ্ছে পয়লা বৈশাখ।
নববর্ষ মূলত প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসা একটা বাৎসরিক উৎসব। এমনকি নববর্ষের সঙ্গে কোনো ধর্মেরও মিল পাওয়া যায়না। আগেকার দিনে নববর্ষ ছিলো মানুষের কাছে ঋতুধর্মী উৎসব। ঋতুর সঙ্গে কৃষি কাজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় নববর্ষ খুব দ্রুত মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়।
আকবরের সময়কাল থেকে পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজ নিজ অঞ্চলের মানুষকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতে শুরু করেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো।
উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিবর্তিত হয়ে এখন এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বইকে বোঝানো হতো। আসলে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সব স্থানেই পুরোনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানিরা তাঁদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। এই প্রথাটি এখনো বেশ প্রচলিত।
তবে অবাক করা একটি বিষয় হলো, পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু একমাত্র বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কোনো ধর্মের মিল নেই। মূলত কৃষি কাজ এবং কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করতে বাংলা বছরের উৎপত্তি। আর নতুন বছরের প্রথম দিনটি বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিন। স্বভাবতই সারা বছর যাতে ভালো যায় সেজন্য বছরের প্রথম দিনটি উৎসব আনন্দের মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার প্রচলন থেকেই আস্তে আস্তে পয়লা বৈশাখ আজকের এই অবস্থানে এসে দাড়িয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা।
১৯১৭ সালে প্রথম আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর পাওয়া যায়। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পয়লা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৮ সালেও ছিল একই আয়োজন। ১৯৬৭ সাল থেকে বাংলার এ অংশ ঘটা করে পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। ঢাকা শহরে পয়লা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট।
পয়লা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। এটাই এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ঢাকার রমনার এই স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চটি তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। মূলত ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।
সেই থেকে আজ অবধি পয়লা বৈশাখ হয়ে উঠেছে প্রতিটি বাঙালির কাছে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসবে।