আঙ্গুলের ছাপ কিভাবে চিহ্নিত করে ?

প্রতিটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ ভিন্ন, কারও সাথে কারও আঙ্গুলের ছাপের কোন মিল নেই। ব্যাপারটা একদিকে যেমন রহস্যজনক, আরেক দিকে সুবিধাজনকও বটে। অপরাধী শনাক্তকরণের জন্য আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা ও অপরাধস্থলে অপরাধীর রেখে যাওয়া আঙ্গুলের ছাপের সাথে সন্দেহভাজন কারও আঙ্গুলের ছাপ মিলিয়ে দেখার প্রক্রিয়াটি বহুদিন থেকেই প্রায় নির্ভুল একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এ ছাড়া গেল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আঙ্গুলের ছাপের এই অনন্য ব্যবহার হয়ে আসছে বিভিন্ন স্থানের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ বা তথ্য যাচাইয়ের জন্যও। যদিও আজকের এই পর্যায়ে আসার জন্য অন্য অনেক আবিষ্কারের মতো ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রুযুক্তিকেও পেরিয়ে আসতে হয়েছে বেশ অনেকগুলো ধাপ। 

কোন সমতল বস্তুর ওপর হাত রাখলে সেখানে যে প্রায় অদৃশ্য একটি ছাপ পড়ে যায় এ বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ সর্বপ্রথম জানতে পারে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে। সে সময় কোনো সমতলে থাকা আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্টকে দৃশ্যমান করার জন্য ডাস্টিং হিসেবে ফাইন পাউডার ব্যবহার করা হতো। ১৮৮০ সালে খ্যাতনামা বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ‘Nature’-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে ইংরেজ দুই বিজ্ঞানী হেনরি ফল্ডস ও উইলিয়াম জেমস হার্শেল প্রথমবারের মতো সবাইকে জানান যে প্রতিটি মানুষের হাতের আঙ্গুলের ছাপই স্বতন্ত্র এবং দীর্ঘস্থায়ী।

পরবর্তীতে আরেক ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার ফ্রান্সিস গ্যালটন এই তথ্য ও নানাবিধ গবেষণার উপর ভিত্তি করে প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট সিস্টেম এর উন্নয়ন ঘটান। মানুষের আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্টের স্বকীয়তা যাচাই ও বিশ্লেষণের জন্য তিনি আঙ্গুলের ছাপে থাকা বাঁক, রেখার পুনরাবৃত্তি ও কুণ্ডলীর অবস্থানগুলো নিয়ে বেশ কিছু গ্রুপ তৈরি করেন। গ্যালটনের উদ্ভাবিত এই প্রক্রিয়াটির আরও কিছু উন্নয়ন ঘটিয়ে একে অনেক বেশি ব্যবহারউপযোগী করে তোলেন লন্ডন পুলিশের তত্কালীন কমিশনার স্যার এডওয়ার্ড আর হেনরি। ১৯০০ সালের জুন মাসে তার তৈরি করা এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিটেকশন সিস্টেমটি গ্যালটন-হেনরি সিস্টেম নামে প্রকাশিত হয়। আর ১৯০১ সাল থেকে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে এর ব্যবহার শুরু করে অপরাধ তদন্ত সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড।

বর্তমানে আঙ্গুলের ছাপ নির্ণয়ের জন্য ডিজিটাল ইমেজ প্রসেসিং ব্যবহার করা হয়। হাতের ছাপের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে ইমেজ প্রসেসিং করে আঙ্গুলের ছাপ নির্ধারণ করা হয়।

প্রথমে হাতের আঙ্গুলের ফিচার গুলোর সাথে পরিচিত হওয়া যাক। এই ফিচার গুলো সম্পর্কে ধারনা থাকলে দুইটি ফিঙ্গার প্রিন্টের মধ্যে পার্থক্য গুলো সহজে বোঝা যাবে।

রিজ (Ridge): আমরা আঙ্গুলের দিকে তাকালে যে রেখা গুলো দেখি সেগুলো কে রিজ বলা হয়।           
ভ্যালি (Valley): দুইটা রিজের মাঝখানের অংশকে ভ্যালি বলা হয়।
টার্মিনেশন (terminations): রিজ এর শেষ প্রান্তকে টার্মিনেশন বলা হয়।
বাইফারকেশন (bifurcations ) : যে স্থান থেকে রিজের শাখা তৈরী হয়। সহজ অর্থে হাতের ছাপের যে পয়েন্টে একটি রেখা থেকে দুইটি রেখা তৈরী হয় সেই পয়েন্টি হল বাইফারকেশন।
মাইনিশীউ(Minutiae): এটি সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন। আঙ্গুলের ছাপের যেখানে টার্মিনেশন কিংবা বাইফারকেশন থাকে, সেখানে একটি বিন্দু কল্পনা করা হয়। এই কল্পিত বিন্দুটিই হল মাইনিশীউ। অন্য কথায় টার্মিনেশন এবং বাইফারকেশন হল মাইনিশীউ। নিচের ছবিতে লাল রঙের ডট গুলো হল মাইনিশীউ

মাইনিশীউ হল আঙ্গুলের ছাপের মূল শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য। মাইনেশিউ গুলোর লোকেশন এক এক ফিঙ্গার প্রিন্টে এক এক রকম। যে কারণে একটি ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে অন্যটির কোন মিল নেই।

আঙ্গুলের ছাপের ছবি থেকে ফিচার বের করার প্রক্রিয়া গুলো হল-
১। আঙ্গুলের ছাপের ছবি সংগ্রহ করা ( বিভিন্ন অপটিক্যাল সেন্সরের সাহায্যে এই ছবি সংগ্রহ করা যেতে পারে )
২। ইমেজকে গেরি স্কেলে রূপান্তর করা ( অপটিক্যাল সেন্সরের সাহায্যে যে কালার ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে তা সাদাকালো ছবিতে রূপান্তর করা )   
৩। ছবির অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেয়া                                                    
৪। আঙ্গুলের ছাপের ছবির মান বাড়ানো 
৫। আঙ্গুলের ছাপের ছবিকে বাইনারী ছবিতে পরিবর্তিত করা ( এখানে রিজগুলোকে ০ দ্বারা ও ভ্যালিকে ১ দ্বারা পরিবর্তিত করা হয় ) 
                                                       ৬। বাইনারী ছবির রিজ অংশকে চিকন করা                                       
                                                       ৭। বাইনারী ছবি থেকে মাইনিশীউ বের করা
                                                 ৮। শনাক্তকরন।                      

নিরাপত্তাজনিত কাজে আঙ্গুলের ছাপ শনাক্তকরণ বেশ উপযোগী একটি প্রক্রিয়া। পুলিশ বিভাগের কাছে হাজার হাজার মানুষের আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষিত থাকে, এবং এর ফলে অপরাধী শনাক্তকরণ অনেক সহজ হয়। দুইটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ একই রকম হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি ২৪ মিলিয়নে একটি। অর্থাৎ দুইজন মানুষের আঙ্গুলের ছাপ এক হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখন আমরা এটাই আশা করি যে একই আঙ্গুলের ছাপবিশিষ্ট দু’জন মানুষের একজন যেন অপরাধী না হন। তা না হলে হয়তো আঙ্গুলের ছাপ মিলে যাবার কারণে অপরাধী না হওয়া সত্ত্বেও নির্দোষ মানুষটি শাস্তি পেতে পারেন।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন