আতশবাজির গল্প

আচ্ছা, তোমরা কি আতশবাজির ঝলকানি দেখেছো আকাশে ? নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এমনকি আমাদের দেশে আতশবাজি পুড়ানো হয় । চোখ ধাঁধানো এই আতশবাজি দেখার মজায় আলাদা। কিন্তু তোমরা কি জানো এই আতশবাজির মাঝে এক অন্যরকম রসায়ন লুকিয়ে আছে ।
 
আতশবাজির ভিতরে তিনটি শক্তির রূপ দেখতে পাওয়া যায় ; শব্দ শক্তি, আলোক শক্তি ও তাপ শক্তি ।
 
বিভিন্ন ধাতব লবণকে পুড়ানো হলে বিভিন্ন রঙের আতশবাজি মূলত দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটা পদার্থের অণুগুলো তাপশক্তি শোষণ করে থাকে। এই শোষিত শক্তি পরবর্তীতে বিভিন্ন আলোক বর্ণ ত্যাগ করে আকাশে। এই আলোক বর্ণ মূলত নির্ভর করে কতটুকু পরিমাণ তাপশক্তি পদার্থ ত্যাগ করছে।
 
 
সোডিয়াম নাইট্রেটকে যখন তাপ দেওয়া হয় সোডিয়াম অণুর ইলেকট্রনগুলো তাপশক্তি শোষণ করে নেই। এর ফলে ইলেকট্রনগুলো উত্তেজিত হয়ে কয়েক সেকেন্ড পরে এই তাপশক্তি ত্যাগ করতে থাকে। এই ইলেকট্রন প্রায় ২০০ কিলোজুল শক্তি ত্যাগ করে যা মূলত হলুদ আলোর শক্তি ।
 
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে একটি পদার্থ থেকে আরেকটি পদার্থের তাপশক্তি ত্যাগের পরিমাণে ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায় । কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশি তাপ শোষণ করে ও বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো কম শক্তির তাপ শোষণ করে।
 
    রঙ
  পদার্থের নাম
  তরঙ্গদৈর্ঘ্য ( Nanometer )
   লাল
    লিথিয়াম কার্বনেট
৬৫২
   কমলা
   ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড
 ৬২৮
   হলুদ
   সোডিয়াম ক্লোরাইড
   ৬১০ – ৬২১
   সবুজ
   বেরিয়াম ক্লোরাইড
   ৫৮৯
   নীল
   কপার ক্লোরাইড
    ৫০৫ – ৫৩৫
  বেগুনী
    কপার ও স্ট্রনটিয়াম পদার্থের মিশ্রণ
    ৪২০ – ৪৬০
        
আতশবাজি মূলত দুই ধাপে পুড়ানো হয় । প্রথম ধাপে আতশবাজির ভিতরে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থগুলো বিশ্লেষিত (Decomposition )  হয় । রাসায়নিক পদার্থগুলো পুরোপুরি বিশ্লেষিত হলে তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরণ ( Detonation ) সংঘটিত
হয় ।
 
 
আমরা যখন আকাশে আতশবাজি দেখি মনে হয় তা বুঝি আমাদের কাছে এসে পড়বে বা কোথাও দূরে সরে যাচ্ছে । আসলে রাতের আকাশে আতশবাজি পুড়ানো হয় বলে আমরা সঠিকভাবে আতশবাজির আকার নির্ণয় করতে পারি না ।
আমরা যখন আতশবাজি দেখি তার কিছুক্ষণ পরে আমরা এর বিস্ফোরণ শুনতে পায় । এর কারণ , আলো শব্দের চেয়ে দ্রুত চলে । আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩০০,০০০,০০০ মিটার , যেখানে শব্দের বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩৪০ মিটার ।  
 
আতশবাজির রসায়ন :
একটি আতশবাজিতে তিনটি অংশ থাকে। জারক, বিজারক এবং রঞ্জক। ধাতব লবণই রঞ্জক হিসেবে কাজ করে। আতশবাজিতে অগ্নিসংযোগের পর ব্ল্যাক “পাউডার” উড্ডয়নের শক্তির যোগান দেয়। ব্ল্যাক পাউডার হল ধীর প্রজ্জলন ক্ষমতা সম্পন্ন যৌগ যাতে ৭৫% পটাশিয়াম নাইট্রেট, ১৫% কাঠকয়লা এবং ১০% সালফার থাকে।
 
আতশবাজিতে অগ্নিসংযোগের পর কতগুলো জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং এর ফলেই তৈরি হয় মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং শব্দ। জারকসমূহ অক্সিজেন গ্যাস সরবারহ করে যা বিজারকদের জ্বালাতে এবং যৌগগুলোকে উত্তেজিত করতে সাহায্য করে। ব্যবহৃত জারকসমূহের মধ্যে রয়েছে নাইট্রেট, ক্লোরেট এবং পারক্লোরেট। বিজারক,সালফার এবং কার্বন, জারক থেকে উৎপন্ন হওয়া অক্সিজেনের সাথে মিশে বিস্ফোরণের শক্তি যোগায়।
 
প্রথম দিকে ব্ল্যাক পাউডারের প্রধান উপাদান নাইট্রেটসমূহই ছিল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জারক। অধিকাংশ সময় পটাশিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হত যা ভেঙে পটাশিয়াম অক্সাইড, নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন গ্যাস দেয়।
 
4KNO3 — 2K2O + 2N2 + 5O2
 
বিক্রিয়ার সময় নাইট্রেট দুটি অক্সিজেন অণু ছেড়ে দেয়। কারণ এক্ষেত্রে সবগুলো অক্সিজেন অণু ছেড়ে দিলে জারণ বিক্রিয়া ঘটে না। অন্যান্য জারণ বিক্রিয়ার মত এই বিক্রিয়াটি খুব শক্তিশালী এবং অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। এই জন্যই ব্ল্যাক পাউডারের প্রধান উপাদান হিসেবে নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়। আতশবাজিতে তাদের কাজটাই হল উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ধাক্কা সৃষ্টি করা এবং ছোট ছোট বিস্ফোরণগুলো ঘটানো।
 
১৮৩০ সনের দিকে ইটালিয়ান আতশবাজি প্রস্তুতকারীরা আরও শক্তিশালী একটি জারক খুঁজে পেলেন যা কিনা ১৭০০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত তাপমাত্রা তৈরি করতে পারে এবং আরও গাঢ় রঙ সৃষ্টি করে। এই জারক হল ক্লোরেট যাদের ক্লোরাইড(ClO3) আয়ন আছে এবং এরা বিক্রিয়ার সময় এদের সকল অক্সিজেন মুক্ত করে দেয়।
 
2KClO3 — 2KCl + 3O2
               
এই বিক্রিয়া আরও বেশি তীব্র এবং আরও বেশি দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু ক্লোরেট নাইট্রেট থেকে অনেক কম স্থিতিশীল এবং যথেষ্ট বিপদজনক। এরা এতটাই অস্থিতিশীল যে শুধুমাত্র মাটিতে ফেলে দিলেই এরা বিস্ফোরিত হয়। এতসব অসুবিধা সত্ত্বেও ক্লোরেট নাইট্রেট অপেক্ষা ভাল জারক আতশবাজির ক্ষেত্রে। ক্লোরেটসমূহ আতশবাজিতে বিস্ফোরণ ঘটায় যেখানে নাইট্রেট ধীর গতির প্রজ্বলন ঘটায়। কিছু কিছু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্লোরেট ব্যবহার করলেও ইদানীং প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই পারক্লোরেট কে বেছে নেয়।
 
পারক্লোরেটে পারক্লোরেট(ClO4) আয়ন বিদ্যমান যেখানে প্রতিটি ক্লোরিন পরমাণু চারটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত। যেহেতু ক্লোরিন তার সর্বোচ্চ সংখ্যক অক্সিজেনের সাথে যুক্ত তাই পারক্লোরেট ক্লোরেট অপেক্ষা অনেক বেশি স্থিতিশীল। তারপরও পারক্লোরেট সবকটি অক্সিজেন ছাড়তে পারে।
 
KClO4 — KCl + 2O2
 
সুতরাং, পারক্লোরেট ক্লোরেটের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল এবং এরা ক্লোরেটের চেয়ে বেশি অক্সিজেন ছাড়তে পারে। তাই এরা জারক হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত। এরাই সবচেয়ে শক্তিশালী বিক্রিয়া ঘটায় এবং সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ফলাফল দেয়। নাইট্রেট, ক্লোরেট এবং পারক্লোরেট থেকে নির্গত অক্সিজেন খুব দ্রুত বিজারকের সাথে বিক্রিয়া করে প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে এবং গ্যাস নিঃসরণ করে। বহুল ব্যবহৃত দুইটি বিজারক হল সালফার এবং কার্বন(কাঠকয়লা)। এরা ব্ল্যাক পাউডারের উপাদান এবং এরাই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে সালফার ডাই অক্সাইড এবং কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন করে।
 
S + O2 — SO2
C + O2 — CO2
 
 এই বিক্রিয়াসমূহ থেকে গ্যাসের পাশাপাশি অনেক তাপও উৎপন্ন হয় যা আশেপাশের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই তাপ আর গ্যাস এত দ্রুতগতিতে ছরিয়ে পড়ে যে এর কারণে বিস্ফোরণের গতি বৃদ্ধি পায়।
 
 
 
 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন