আবিষ্কারের স্বীকৃতি

মানুষ এমনি এক প্রাণী যে প্রতিনিয়ত ভেবেই চলেছে কীভাবে নতুন নতুন জিনিস তৈরি করা যায়। মানুষের এমন ইচ্ছার পেছনে কাজ করে কৌতূহল। নতুন কিছু নিয়ে কাজ করার বাসনাই মানুষকে টেনে নিয়ে যায় আবিষ্কারের নেশায়। প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হচ্ছে শত শত বস্তু, এদের আবিষ্কারকও অনেক। কিন্তু সবাই তো মানুষ, তাই এতসব বিজ্ঞানীদের মাঝে কারও কারও চিন্তা-ভাবনা মিলে যেতেই পারে। আর তার ফলে যা দাঁড়াবে তা হল দুই বিজ্ঞানীর একই বস্তু উদ্ভাবন, অতঃপর ঐ বস্তুর সঠিক উদ্ভাবক কে তা নিয়ে ঝঞ্ঝাট। এসব ঝামেলা এড়াতে সব দেশেই প্রশাসনিক পর্যায়ে থাকে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর, যার দায়িত্ব হল নব্য আবিষ্কৃত কোন বস্তুর অনুমোদন প্রদান। এর ফলে উক্ত বস্তুর সঠিক আবিষ্কারক কে তা জানা যায় এবং আবিষ্কার সংক্রান্ত ঝামেলা এড়ানো যায়।

পেটেন্ট হল এক ধরণের অধিকার প্রদানের অনুমোদন। নব্য উদ্ভাবিত কোন বস্তুর অনুমোদন প্রদানে এই অধিকার দেয়া হয়। উদ্ভাবনটি যেকোনো পণ্য হতে পারে, আবার এমন কোন পদ্ধতি হতে পারে যা মানুষের কাজে আসে। উক্ত বস্তু বা পদ্ধতির পেটেন্ট করানোর ফলে পেটেন্ট অনুমোদনকারী সংস্থা উদ্ভাবনকারীকে এক ধরণের সুরক্ষা দেয়। এই সুরক্ষার মানে হল, উক্ত ব্যক্তির পেটেন্টকৃত বস্তু বা পদ্ধতি পেটেন্ট মালিকের অনুমতি ছাড়া বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। পেটেন্ট সম্পর্কিত অধিকারগুলো সাধারণত আদালত কার্যকর করে দেয় এবং এই অধিকার সাধারণত ২০ বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে। আবার, যেকোনো কারণে আদালত উক্ত ব্যক্তিকে দেয়া পেটেন্ট বাতিলও করে দিতে পারে।

পেটেন্ট করানোর মূল কারণ হল নিজের স্বত্ত্বতা দাবি ও প্রতিষ্ঠা। ধরা যাক, কেউ এমন কিছু আবিষ্কার করলো যা পূর্বে কেউ করেনি। একই সময়ে অন্য আরেক ব্যক্তিও পূর্বের ব্যক্তির ধারণা নিয়ে একই জিনিস তৈরি করে দাবি করলো যে সে-ই প্রকৃত আবিষ্কারক। এমন সব ঘটনা এড়াতেই পেটেন্টের প্রয়োজন হয়। কোন ব্যক্তি কোন জিনিস বা পদ্ধতি উদ্ভাবন করার পর সরকারী অধিদপ্তরে একটি পেটেন্ট আবেদনপত্র দাখিল করে। ঐ আবেদনপত্রে উদ্ভাবকের নাম এবং উদ্ভাবিত বস্তুটি কোন শাখায় ব্যবহার করা যাবে তা লিখতে হয়। এরপর উদ্ভাবনের পটভূমি এবং ব্যবহার পদ্ধতি বিস্তারিত লিখতে হয়।

পেটেন্টের জন্য আবেদন করতে হয় জাতীয়  পেটেন্ট অফিস বা আঞ্চলিক পেটেন্ট অফিসে। আঞ্চলিক পেটেন্ট অফিস সাধারণত বেশ কয়েকটি দেশের হয়ে কাজ করে থাকে, যেমন- ইউরোপীয় পেটেন্ট অফিস ( EPO ) এবং আফ্রিকান মেধা সম্পদ সংস্থা ( OAPI )। এই ধরণের আঞ্চলিক পেটেন্ট পদ্ধতিতে একটি মাত্র আবেদনপত্রের মাধ্যমে এক বা একাধিক দেশে পেটেন্টের জন্য আবেদন করা যায় এবং প্রত্যেকটি দেশ তাদের ভূখন্ডে সুরক্ষার আবেদন গ্রহণ করবে কি বা করবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

WIPO পরিচালিত পেটেন্ট সহযোগিতা চুক্তি ( Patent Cooperation Treaty ) এক্ষেত্রে একটি মাত্র আন্তর্জাতিক আবেদনপত্র দাখিলের সুবিধা প্রদান করে, যেটা অনেকটা নিজ দেশের পেটেন্ট অফিসে আবেদন করার মত। সুরক্ষা পেতে আগ্রহী কোনো আবেদনকারী একটি মাত্র আবেদন দাখিল করতে পারেন এবং যতগুলো দেশ সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে তাঁর সবগুলো দেশে তিনি সেটা সুরক্ষার অনুরোধ জানাতে পারেন।

১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় টেক জায়ান্ট অ্যাপলের বিরুদ্ধে একটি মামলা ঠুকে দেয়। বিষয়টি ছিল, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত এবং পেটেন্টকৃত মাইক্রোচিপ অনুমতি ছাড়াই অ্যাপল ব্যবহার করেছে তাদের মোবাইল ফোনে। আর এই ১৭ বছর পরে এসে সেই মামলার রায়ে হেরে গিয়ে অ্যাপলকে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে প্রায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার !

আমরা সবাই জানি যে রেডিওর আবিস্কারক হলেন ইটালীর জি. মার্কনী। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে রেডিওর আসল আবিষ্কারক আমাদের উপমহাদেশেরই একজন, তিনি হলেন জগদীশচন্দ্র বসু। মার্কনী যে কোহেরার ( বর্তমান সময়ের ট্রান্সমিটার ) ব্যবহার করে রেডিও তৈরি করেন, তা ছিল জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কৃত। শুধু জগদীশচন্দ্র ব্যবহার করেন U আকৃতির কোহেরার, আর মার্কনীরটি ছিল সোজা। কিন্তু জগদীশচন্দ্র তাঁর আবিষ্কারের পেটেন্ট করেন নি বলেই রেডিওর আবিষ্কারক হিসেবে মার্কনী স্বীকৃতি পান। এ থেকেই বোঝা যায় যে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেই নয়, একটি দেশের উন্নতির জন্য, এবং সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য পেটেন্ট আইনের সঠিক ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন