খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ার বাসিন্দা মমতাজ শম্পা। এবারের জেএসসি পরিক্ষায় তার মেয়ে রুবাইয়াত ফাইরুজ অংশ নেন। পরীক্ষার আগের রাতে খবর পেয়েছিলেন এবারের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সেই প্রশ্নের কপির জন্য তিনি ছুটে যান মেয়ের প্রাইভেট টিউটরের কাছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই টিউটরের কাছে তিনি পেয়েও যান একটি সংক্ষিপ্ত সাজেশন। কিন্তু সেই সাজেশনের সব প্রশ্নই হুবহু আর মেলেনি পরের দিনের প্রশ্নের সাথে।
দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষার প্রশ্নের জন্য সেই টিউটরই ফোনে সাজেশন দেয় রুবাইয়াতকে। আগের দিনের অভিজ্ঞতার কথা মনে করে শুধু সেই সাজেশনই রিভাইজ না করে পুরো বইয়ের পড়াতেই একবার চোখ মেলে নেয় সে। পরের দিনের পরীক্ষায় তেমন কোনো প্রশ্নের মিল না পেয়ে আর ওদিকে মন দেয়নি মা ও মেয়ের দুজনেই।
মমতাজ শম্পা জানান, তার প্রতিবেশীই তাকে ঠেলে দিয়েছেন এই পথে। সেই প্রতিবেশীর মেয়ে গতবারের জেএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে আগে সবগুলো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন। সেই প্রশ্ন হলের প্রশ্নের সাথে পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল বলে তার দাবি। তার মেয়ে সেবারের পরীক্ষায় জিপিএ পাঁচ পায়।
এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের চারপাশে। বিগত বছরগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে বেশ কিছু পরীক্ষা বাতিলও করা হয়েছে। আবার অনেক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলেও সে ব্যাপারে কোনো কর্ণপাত করেননি সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
তবে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফাঁসের গুজবের শিকার হতে হচ্ছে আমাদের কোমলমতি খুদে শিক্ষার্থীদের। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার মতো এত বড় একটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এমনিতেই নানামুখি চাপে থাকে এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সেই সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ফাঁসের গুজবের কারণে তাদের কোমল মনে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এমন ঘটনাও হয়েছে ফাঁস প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ক্লাসের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছেলে বা মেয়েটি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। আর ফাঁসকৃত প্রশ্ন ছাড়াই নিজের প্রচেষ্টায় পরীক্ষা দিয়ে একটু কম ভালো ফল করায় বকাঝকার শিকার হতে হয়েছে ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীটিকে।
যে সমস্ত শিক্ষার্থী প্রশ্ন ফাঁসের অবৈধ পন্থার সুযোগ নিয়ে ভালো ফল করছে আর যারা এ ধরণের বিপথের সুযোগ না নিয়ে সত্যিকারের পড়াশুনা করে অপেক্ষাকৃত কম ভালো ফল করছে উভয় দলই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংকটে ভোগে।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই দুরারোগ্য ব্যাধি দিন যতো যাচ্ছে ততো বাড়ছে। আর এজন্য ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি ও যোগাযোগ মাধ্যম। দেখা গেছে পরীক্ষার আগে আগে শিক্ষার্থীর পাশে থেকে তাকে সাহস ও নির্ভরতা না দিয়ে অভিভাবকেরা নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকেন পরের দিনের পরীক্ষার ফাঁস প্রশ্নপত্রের জন্য।
প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, এমনকি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগও বেশ পুরোনো।
গত চার বছরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ৬৩টি প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিন্তু গত ৩৫ বছরে কারো উপযুক্ত শাস্তি হয়নি।
অথচ প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা প্রতিরোধে দেশে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। আইনে বলা আছে প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার ন্যূনতম শাস্তি ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ড। পাবলিক পরীক্ষাসমূহ [অপরাধ] আইন ১৯৮০ ও সংশোধনী ১৯৯২ আইনের চার নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান রয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের জন্য কারো শাস্তি না হলেও এর প্রভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তাদের ক্ষতির মাত্রা সর্ম্পকে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিদ ড. মেহজাবীন হক বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের বেশিরভাগ শিকার যারা হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই বয়সে শিশু। পিএসসি পরীক্ষা যারা দিচ্ছে তাদের বয়স ১০ থেকে ১১ বছর। এই বয়সের শিশুদের প্রধান যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটা হলো মুল্যবোধের অবক্ষয়।
আমরা নিজেরাই তাদের হাতে ফাঁস প্রশ্নপত্র তুলে দিয়ে দুর্নীতির হাতেখড়ি করছি। যে সময় তারা বই নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সেই সময় সে পরীক্ষার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষায় থাকে। এমনও অনেক হয়, সে যে প্রশ্নপ্রত্রটি আগের রাতে পেল পরের দিনের পরীক্ষায় হয়তো তা মিললই না। তখন সেটা তার জন্য আরো হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যান্য পরীক্ষাগুলোও তখন খারাপ হওয়ার ভয় থাকে। তিনি আরো জানান প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটা দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়ে এসব কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের উপর।
অভিভাবকরা নিজেরাই বা কেনো এসব কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে চেষ্টা তদবির করে ফাঁস প্রশ্নপত্র তুলে দিচ্ছেন ? মেহজাবীন হক বলেন, এর কারণ এখন তাদের কাছে শিক্ষার চাইতে সার্টিফিকেট প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সন্তান কী শিখল সেটা এখন আর তাদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয় বরং সন্তান পরীক্ষায় কি গ্রেড অর্জন করল সেটাই এখন তাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো রেজাল্টের প্রলোভনে পড়ে, মূল্যবোধের কোনো তোয়াক্কা না করে এটা করছেন তারা।
প্রশ্ন ফাঁসের হাত থেকে এসব শিশুদের বাঁচাতে হলে করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যারা অভিভাবক আছি তাদেরকে মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। ফাঁস প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করলে তা কোনোভাবেই সেই শিক্ষার্থীর জন্য সুফল বয়ে আনবে না এটা অভিভাবকদের বুঝতে হবে।
যখন অভিভাবকরা নিজেরা ফাঁস প্রশ্নপত্রের প্রতি অনীহা দেখাবে তখন যারা প্রশ্ন ফাঁস করেন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন প্রশ্ন ফাঁসের প্রতি। তখন আস্তে আস্তে এমনিতেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রবণতা কমে যাবে। মনে রাখতে হবে জীবনে সফলতার জন্য লোক দেখানো ভালো রেজাল্টের চাইতে সঠিক বিদ্যাটা অনেক বেশি প্রয়োজন।