বাংলায় অ্যানিমেশন ফিল্ম ?

“আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম। খানিকক্ষণ আমি কোন কথা বলতে পারলাম নাহ। মেয়েটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমি নেটওয়ার্কে মেয়েটির ছবি দেখেছি , কালো চুল, কালো গভীর চোখ, মসৃণ ত্বক। ছবিতে শুধুমাত্র চেহারার সৌন্দর্য ধরা পড়ে- ভেতরের সৌন্দর্য ধরা পড়ে না। সামনাসামনি কথা বলে বোঝা যায় যে, মেয়েটির ভিতরেও এক ধরনের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে”।

উপরোক্ত সংলাপটি বাংলা অ্যানিমেশন ফিল্মের। পিলে চমকানোর মতো ব্যাপার, তাই না ? 

টয় স্টোরি কিংবা ডেসপিক্যাবল মি দেখার সময় নিশ্চয়ই সবার একবার হলেও মনে হয়েছে, আহা, বাংলাতেও যদি এমন অ্যানিমেশন ফিল্ম থাকতো! 

বছর পনেরো আগের মন্টু মিয়ার অভিযানের কথা মনে করে হয়তো অনেকে দীর্ঘশ্বাসও ফেলে। সেই লুঙ্গি পরা ডেঁয়ো পিঁপড়া, যে মানুষের দুঃখ-কষ্ট একদম সইতে পারে না। কথা বলে আঞ্চলিক টানে।

খুব অল্প সময়ে দারুণ সাড়া জাগালেও মন্টু মিয়ার অভিযান নিয়ে আসলে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আমাদের তেমন কিছু করার নেই। আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশের প্রথম কাল্পনিক সুপারহিরো মন্টু মিয়া কেন যে আমাদের চলচ্চিত্রে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারলো না, সেটা একটা রহস্য।

তার একটা কারণ সম্ভবত মন্টু মিয়াকে বড় পর্দার বদলে ছোট পর্দায় টেলিভিশনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। অ্যানিমেশনের মতো ব্যাপক একটা বিষয়কে আসলে ছোটপর্দায় তুলে আনা বেশ মুশকিল। যে কারণে অ্যানিমেশনের গুরু হলিউডেও টেলিভিশনে তেমন অ্যানিমেশনের কাজকর্ম দেখা যায় না।

এবার একটু অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাক।

গেম দিয়ে শুরু

২০০২ সালের দিকে বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্ট পারসন শুটার গেম অরুণোদয়ের অগ্নিশিখা তৈরি করেছিল শম কম্পিউটার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই টিমের প্রধান ও গেমটির ডিজাইনার ছিলেন রাজীব আহমেদ। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের বাজার তখনও এ ধরণের পণ্যের জন্য তৈরি হয়নি । 

হলিউডে তখন ফাইন্ডিং নিমো, কার্স, শ্রেক নিয়ে জয়জয়কার। শুরুতে শুধু শিশুদের জন্য তৈরি করা হলেও বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই দেখছে মুভিগুলো। থ্রিডি অ্যানিমেশন যে একটা সুবিশাল স্বয়ংসম্পূর্ণ ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হতে যাচ্ছে ততদিনে মোটামুটি স্পষ্ট।

কিন্তু চলচ্চিত্র বললেই কি আর চলচ্চিত্র হয়? টিভি নাটকের সাথে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ভালো গল্প দরকার, ভালো চিত্রনাট্য দরকার। সঙ্গে দরকার দক্ষ পরিচালনা, ক্যামেরা মুভমেন্ট।

ত্রাতুলের জগৎ

সৌভাগ্যক্রমে গল্প আর চিত্রনাট্য নিয়ে খুব একটা ভাবতে হলো না তরুণ নির্মাতাদের। ২০০২ সালে প্রকাশিত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন ত্রাতুলের জগৎকে গল্প হিসেবে বাছাই করা হলো। গল্প থেকে চিত্রনাট্যও হয়ে গেলো। এরপর সেটা জাফর ইকবালকে দেখানো হলো।

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাদের চিত্রনাট্য দেখে কাজ করার অনুমতি দিলেন। তারপর ল্যাবে কাজ শুরু হল। তখন তাদের কাছে কিছুই নাই। শুধু একটা চিত্রনাট্য আর সাতজন আর্টিস্টের একটা  টিম।’

জাফর ইকবাল অবশ্য বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ‘কাজটা খুবই দুরূহ। আপনারা যেভাবে ভাবছেন সেভাবে হয়তো না-ও হতে পারে।’

ভুল বলেননি কথাসাহিত্যিক। নির্মাতারা বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারিনি কাজটা এত দুরূহ হবে !  প্রতিটা জিনিস আমাদের শূন্য থেকে শুরু থেকে তৈরি হয়েছে। চিত্রনাট্য ছাড়াও মডেল তৈরি করা, সেট তৈরি করা, কাহিনী আগানো সবকিছু আমাদের শূন্য থেকে শুরু করে একটু একটু করে আগাতে হয়েছে’।

বজ্রগম্ভীর কণ্ঠের প্লেব্যাক দিয়ে শুরু হলো সিনেমাটি, ‘ত্রাতুল।  নিউক্লিয়ার সংঘর্ষের পর গড়ে ওঠা সভ্যতার বিদ্রোহী একজন মানুষ…’ 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রায় তিন বছর কাজ চলার পর বন্ধ হয়ে যায় ত্রাতুলের জগৎ। অনেক রকম বাধা-বিপত্তি আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এত বিশাল একটা প্রজেক্ট চালানো রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অ্যানিমেশনের জন্য যে অত্যন্ত হাই কনফিগারেশনের কম্পিউটার লাগে তার অভাব ছিল। কিন্তু এত স্বপ্ন আর শ্রমের ফসল এই প্রজেক্ট কি তাহলে অসমাপ্তই থেকে যাবে? বাংলায় আমরা কোনো পূর্ণাঙ্গ অ্যানিমেশন মুভি পাবো না?

 

এই চিন্তাটি মেনে নিতে পারলেন না রাজশাহীর ইয়াসিন রেজা। ম্যাজিকইমেজ নামে ছোট্ট একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী তিনি। ত্রাতুলের জগতের প্রধান ডিজাইনার রাজীব আহমেদ তারই ছাত্র।

ম্যাজিকইমেজের অভিজ্ঞতা বলতে ছিল টুডি অ্যানিমেশন নিয়ে টুকটাক কাজ করা। চ্যালেঞ্জিং একটা প্রজেক্ট খুঁজতে খুঁজতেই ইয়াসিন রেজা জানতে পারলেন ত্রাতুলের জগতের কথা। তার ছাত্রের প্রজেক্ট। 

অবশ্য ম্যাজিকইমেজকে ত্রাতুলের জগৎ মুভির জন্য কি পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে তা ইয়াসিন রেজার কথা থেকে বোঝা যায়, ‘একটা কমপ্লিট থ্রিডি মুভি হওয়ায় এর অনেক টেকনোলজিক্যাল সমস্যা ছিল, যেগুলো রাজশাহী থেকে মেকাপ করা কঠিন। আমার ছেলেরা অসম্ভব পরিশ্রম করে ছয় মাসের মাথায় কাজটি শেষ করেছে। ’

২৫টি চরিত্র ও ৪০টি সেট নিয়ে ম্যাজিকইমেজ ৯০ ভাগ কাজ শেষ করে থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স ও মায়া অ্যানিমেশন সফটওয়্যারে। পুরো ছবির মধ্যে যত্ন আর পেশাদারিত্বের ছাপ রয়েছে। বিভিন্ন চরিত্রের অভিব্যক্তি, হাঁটাচলা, ভয়েস অ্যাক্টিং, স্পেশাল ইফেক্ট দেখে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না প্রায় সাত-আট বছর আগে বাংলাদেশের এরকম কাজ হয়েছে। এদিক দিয়ে প্রতিবেশী সবগুলো দেশের চেয়ে আমরা এগিয়ে। যদিও গত তিন-চার বছর ধরে ভারতে নিজস্ব অ্যানিমেশন শিল্প গড়ে উঠছে।

অ্যানিমেশনের কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে রেন্ডারিং, আর দ্রুত রেন্ডারিং এর জন্য লো-পলিগন নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এতে যদিও ছবিটির গ্রাফিক্যাল চাকচিক্য কিছুটা কমে গেছে, কিন্তু অল্প রিসোর্স দিয়ে কাজটি শেষ করা গেছে। আইআইটিএম নামে একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ম্যাজিকইমেজকে সাহায্য করে।

২০০৯ সালে এসে শেষ হয় ত্রাতুলের জগতের কাজ। সে বছরই বিটিভি এটি সম্প্রচার হয়।

কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রাতুলের জগৎ চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়নি এবং কোনো সিনেমা হলে মুক্তি পায়নি, এই আফসোস আমাদের সবসময়ই থাকবে।

তবে চিন্তা নেই। অ্যানিমেশনের ইতিহাস নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাদের জানা আছে প্রথম অ্যানিমেশন ফিল্ম টয় স্টোরি তৈরির পেছনের গল্প। কেবল শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে যে একটা নতুন শিল্প দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, তার প্রমাণ টয় স্টোরি। 

 

 

 

 

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন